১৪৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকার ঋণ খেলাপির মামলায় মোস্তফা গ্রুপের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেন আদালত / ফাইল ছবি

এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোস্তফা গ্রুপ। গ্রুপটি এখন ঋণের ভারে নুয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ঋণসংক্রান্ত এক মামলায় গ্রুপটির চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের ৬৮.৪৭ শতক আবাসিক ভূমি এবং সেখানে অবস্থিত বিলাসবহুল স্থাপনা বাজেয়াপ্তের আদেশ দিয়েছে অর্থঋণ আদালত। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর মৌজায় তাদের এসব সম্পত্তি অবস্থিত বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক ছিল মোস্তফা গ্রুপ। ২০২২ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটিতে তাদের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। যার পুরোটাই খেলাপি। গত তিন বছরে ঋণগুলো আদায়ের জন্য দফায় দফায় বৈঠক করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অর্থ ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরিশোধ করেনি মোস্তফা গ্রুপ। তাই ঋণ আদায়ে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা করে সাউথইস্ট ব্যাংক।

গ্রুপভুক্ত কোম্পানি মোস্তফা অয়েল প্রোডাক্টস লিমিটেড ৮৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা, মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড ১৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, মোস্তফা ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং এম এম ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টস লিমিটেড ৩৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিলেও তা ফেরত দেয়নি

মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গ্রুপভুক্ত কোম্পানি মোস্তফা অয়েল প্রোডাক্টস লিমিটেড ৮৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা, মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড ১৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, মোস্তফা ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা এবং এম এম ভেজিটেবল অয়েল প্রোডাক্টস লিমিটেড ৩৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিলেও তা ফেরত দেয়নি। পরবর্তীতে ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ মার্চ মোস্তফা গ্রুপের অধীনে থাকা ৬৮.৪৭ শতক আবাসিক ভূমি এবং সেখানে অবস্থিত বিলাসবহুল স্থাপনা বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত।

বিষয়টি নিশ্চিত করে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের একটি মামলা ছিল। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এর বেশি আর কিছু বলতে পারছি না।

সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের খাতুনগঞ্জ শাখা / ছবি- সংগৃহীত 

তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাউথইস্ট ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোস্তফা গ্রুপ দীর্ঘদিন ব্যাংকের পাওনা অর্থ পরিশোধ করছিল না। তিন বছর আগে থেকেই তারা ঋণখেলাপি। আদালতে আমাদের একটি আপিল ছিল, তাদের সম্পত্তি ব্যাংককে দেওয়ার জন্য। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন।

ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ মার্চ মোস্তফা গ্রুপের অধীনে থাকা ৬৮.৪৭ শতক আবাসিক ভূমি এবং সেখানে অবস্থিত বিলাসবহুল স্থাপনা বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত

তিনি আরও বলেন, অর্থ পরিশোধের জন্য মোস্তফা গ্রুপের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। বারবার তারা টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। ঋণ পুনঃতফসিল করতে সরকার বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছে। সেটাও তারা নেয়নি। বাধ্য হয়ে আমরা আদালতের শরণাপন্ন হই। আদালত যেসব সম্পত্তি মর্টগেজ (বন্ধক রাখা) নেই, এমন সম্পত্তি যেমন- তাদের বসতভিটা ও ভূমি বাজেয়াপ্তের জন্য আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন।

ওই কর্মকর্তার ভাষায়, তারা (মোস্তফা গ্রুপ) এখন ঋণ পুনঃতফসিল করতে চাচ্ছে। কিন্তু এখন সেই সুযোগ নেই। এছাড়া পুনঃতফসিলের যেসব শর্ত তাও তারা পূরণ করছে না। ঋণের বিপরীতে পার্সোনাল গ্যারান্টি বা সিকিউরিটি দিতেও কেউ রাজি হচ্ছে না। এখন আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

প্রসঙ্গত, মোস্তফা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান। তার মৃত্যুর পর গ্রুপের চেয়ারম্যান হন বড় ছেলে হেফাজতুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পান জহির উদ্দিন। তাদের ভাই কফিল উদ্দিন গ্রুপটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, শফিক উদ্দিন ভাইস চেয়ারম্যান ও কামাল উদ্দিনসহ তিনজন পরিচালক হিসেবে আছেন।

কয়েক দশক ধরে ভোজ্যতেল ও ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ব্যবসায় নেতৃত্ব দেয় মোস্তফা গ্রুপ / ছবি- সংগৃহীত

জমি ও স্থাপনা বাজেয়াপ্তের বিষয়ে মোস্তফা গ্রুপের চেয়ারম্যান হেফাজতুর রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। গ্রুপের অর্থবিষয়ক কর্মকর্তা স্বপন দাশগুপ্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কেন ডুবতে বসেছে মোস্তফা গ্রুপ

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক দশক ধরে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় নেতৃত্ব দেওয়া শিল্পগ্রুপটি সম্প্রতি ঋণে জর্জরিত হয়ে ডুবতে বসেছে। বন্ধ হয়ে গেছে গ্রুপটির বিভিন্ন ব্যবসার খাত। এমনকি ভোগ্যপণ্যের ব্যবসাও হাতছাড়া হয়েছে। ঋণের বোঝায় টিকে থাকা অন্য খাতগুলোও এখন ধুঁকছে।

বাবার মৃত্যুর পর সাত সন্তান ব্যবসার পরিধি বাড়াতে ঋণের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তারা ভোগ্যপণ্য ও ভোজ্যতেল আমদানি, শিপব্রেকিং, পেপার মিলসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেন। স্বল্পমেয়াদের ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করেন দীর্ঘমেয়াদের সম্পদ গড়তে। কিন্তু সুদক্ষ ও সৎ ব্যবস্থাপনার অভাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপটির অবস্থা দিনদিন নাজুক হয়ে পড়ে 

স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের কেন এমন ভরাডুবি— জানতে চাইলে তারা বলেন, ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোস্তফা রহমানের মৃত্যুর পর পরবর্তী প্রজন্মের অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় গ্রুপটির পতন শুরু। বাবার মৃত্যুর পর সাত সন্তান ব্যবসার পরিধি বাড়াতে ঋণের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তারা ভোগ্যপণ্য ও ভোজ্যতেল আমদানি, শিপব্রেকিং, পেপার মিলসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেন। স্বল্পমেয়াদের ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করেন দীর্ঘমেয়াদের সম্পদ গড়তে। কিন্তু সুদক্ষ ও সৎ ব্যবস্থাপনার অভাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপটির অবস্থা দিনদিন নাজুক হয়ে পড়ে।

ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে গিয়ে এক সময় বিশাল অঙ্কের ঋণের ফাঁদে পড়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোস্তফা গ্রুপ / ছবি- সংগৃহীত

অন্যদিকে, দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সুনাম থাকায় ব্যাংকগুলোও শিল্পগ্রুপটির চাহিদা মতো ঋণ প্রদান করে। সেই ঋণের বোঝায় মোস্তফা রহমানের কষ্টে গড়া শিল্পগ্রুপটি আজ দেউলিয়ার পথে। খেলাপি ঋণের জন্য পরিচালকদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের দায়ের করা চারটি মামলায় গ্রুপের চেয়ারম্যান হেফাজেতুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকি পরিচালকদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে রয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা।

গ্রুপটির খেলাপি হওয়া ঋণগুলোর বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে ২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। বর্তমানে মোস্তফা গ্রুপের কাছে ব্যাংকসহ ৩১টিরও বেশি আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের পাওনা দুই হাজার কোটি টাকার অধিক

জানা গেছে, গ্রুপটির খেলাপি হওয়া ঋণগুলোর বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে ২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। বর্তমানে মোস্তফা গ্রুপের কাছে ব্যাংকসহ ৩১টিরও বেশি আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের পাওনা দুই হাজার কোটি টাকার অধিক।

মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান / ছবি- সংগৃহীত

মোস্তফা গ্রুপের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার পাওনা ৩০০ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ১৩৫ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার সাড়ে ৫৬ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার সাড়ে ৩৫ কোটি, উত্তরা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার সাড়ে ৩৩ কোটি, এনসিসি ব্যাংক আন্দরকিল্লা শাখার সাড়ে ৩১ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ২১ কোটি, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাড়ে ১৮ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের সাড়ে ১৭ কোটি, ইউসিবিএল জুবিলী রোড শাখার ১৬ কোটি এবং ব্যাংক আল ফালাহ আগ্রাবাদ শাখার সাড়ে ছয় কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।

এছাড়া প্রাইম ব্যাংকের ৮০ কোটি, পূবালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৬৫ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট আগ্রাবাদ শাখার ৪০ কোটি, এক্সিম ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ৪০ কোটি, রূপালী ব্যাংক লালদীঘি শাখার ২৮ কোটি, মাইডাস ফিন্যান্স লিমিটেডের ২২ কোটি টাকাসহ ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা, ইস্টার্ন ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংকের বড় অঙ্কের অর্থ পাওনা রয়েছে।
 
এসআই/এমএআর/ওএফ