সীমা লঙ্ঘন করে ১১ ব্যাংকের আগ্রাসী ঋণ
আইনের মধ্যে আনতে ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাতসীমা (এডিআর) বাড়ানো হয়েছে। তারপরও আগ্রাসী বিনিয়োগ ঠেকাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এডিআর সীমার বাইরে ঋণ দিয়েছে সরকারি ও বেসরকারি ১১ বাণিজ্যিক ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের করা এডিআর নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারির হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত আইনে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে টানা পাঁচবার এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও অনেক ব্যাংক এটি সমন্বয় করতে পারেনি। পরবর্তীতে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে গতি আনা, ব্যাংক খাতের সার্বিক তারল্য পরিস্থিতির উন্নয়নে এডিআর ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা এবং ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত ব্যাংকগুলো ৯২ টাকা পর্যন্ত ঋণ বা বিনিয়োগ করতে পারে। এ সুবিধা পাওয়ার পরও ১১টি ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করেছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা এবং ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত ব্যাংকগুলো ৯২ টাকা পর্যন্ত ঋণ বা বিনিয়োগ করতে পারে। এ সুবিধা পাওয়ার পরও ১১টি ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯০ দশমিক ৯৬ শতাংশ, বেসরকারি এবি ব্যাংকের ৮৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৯১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংকের ৯৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ, এনআরবিসি ব্যাংকের ৮৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। দেশে পরিচালিত বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংক আল-ফালাহ সীমা অতিক্রম করে ঋণ দিয়েছে ৮৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।
এছাড়া ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইনি সীমার বাইরে বিনিয়োগ রয়েছে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৪ দশমিক ২১ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯২ দশমিক ১৫ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ২০ শতাংশ এবং পূবালী ব্যাংকের শরিয়াহ শাখা সীমা লঙ্ঘন করে বিনিয়োগ করেছে ৯৬ দশমিক ১৪ শতাংশ।
বেসিক ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯০ দশমিক ৯৬ শতাংশ, বেসরকারি এবি ব্যাংকের ৮৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৯১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংকের ৯৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ, এনআরবিসি ব্যাংকের ৮৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ব্যাংক আল-ফালাহ সীমা অতিক্রম করে ঋণ দিয়েছে ৮৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়া আইনি সীমার বাইরে বিনিয়োগ রয়েছে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৪ দশমিক ২১ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯২ দশমিক ১৫ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ২০ শতাংশ এবং পূবালী ব্যাংকের শরিয়াহ শাখা সীমা লঙ্ঘন করে বিনিয়োগ করেছে ৯৬ দশমিক ১৪ শতাংশ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে ঋণ বা বিনিয়োগের বিষয়টি ভালো চোখে দেখছেন না অর্থনীতিবিদ ও খাত-সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমানতের বিপরীতে ব্যাংক কত টাকা ঋণ দিতে পারবে তার একটা সীমা নির্ধারণ করা দেওয়া আছে। তারপরও কয়েকটি ব্যাংক সীমা লঙ্ঘন করে কেন ঋণ দিচ্ছে, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখা উচিত। বিষয়টি তদারকি করে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেটাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।’
আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি দিলে ব্যাংক ঝুঁকিতে থাকে— জানিয়ে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ের চিত্র এখন খুব একটা সন্তোষজনক নয়। এমন অবস্থায় অতিরিক্ত ঋণ দিয়ে যদি খেলাপি আরও বেড়ে যায় তাতে আমানতকারীদের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা থাকে। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ দরকার।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমানতের বিপরীতে কত টাকা ঋণ দিতে পারবে, এর একটা সীমা নির্ধারিত আছে। তবে, ব্যাংকগুলোর এ অনুপাত বিভিন্ন সময় ওঠা-নামা করে। কারণ, কোনো একটা ব্যাংকের যদি বড় একটা আমানত আসে তাহলে তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা বেড়ে যায়। একইভাবে হঠাৎ করে কোনো গ্রাহক আমানত তুলে নিলে তখন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। তখন ব্যাংক তার এডিআর সীমার বাইরে চলে যায়। এটা স্বাভাবিকভাবে হতে পারে।’
‘তবে, আমরা যেটা বেশি নজর দিই তা হলো, দীর্ঘমেয়াদি এডিআর সীমার বাইরে কোনো ব্যাংক রয়েছে কি না। থাকলে কেন রয়েছে তা তদারকি করি। অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। যেমন, সাম্প্রতিক সময়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের বিরুদ্ধে এডিআর না কমালে ঋণ দিতে পারবে না বলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এভাবে যাদের অনিয়ম পাব তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং নেব।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১২ লাখ ৩৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। যা মোট আমানতের ৭৩ দশমিক ৭০ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বেশিরভাগ ব্যাংকের এডিআর রেশিও নির্ধারিত সীমার মধ্যেই রয়েছে। যারা আইনি সীমার বাইরে ঋণ বা বিনিয়োগ করেছে তাদের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ১৫ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এর বিপরীতের ঋণ দিয়েছে ১৪ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা, যা আমানতের ৯০.৯৬ শতাংশ।
বেসরকারি এবি ব্যাংকের আমানত ২৮ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। ঋণ দিয়েছে ২৭ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকটির বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুই হাজার ১৮৮ কোটি টাকার আমানত আছে। ব্যাংকটির রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ৬৩৪ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের এডিআর ৯১.০৭ শতাংশ। ব্যাংকটি ৪৫ হাজার ৩৪১ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ৪৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। তাদের ইডিএফের ঋণ এক হাজার ১৭৩ কোটি টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী পদ্মা ব্যাংকের এডিআর রেশিও থাকার কথা ছিল ৮৭ শতাংশ। তাদের এ রেশিও সীমা অতিক্রম করে দাঁড়িয়েছে ৯৭.৭৬ শতাংশ। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকটিতে গ্রাহকের আমানত রয়েছে পাঁচ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের জমা আছে ৮৩৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতের তারা ঋণ দিয়েছে পাঁচ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা।
এনআরবিসি ব্যাংকের আমানত ১১ হাজার ৮৮৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। তাদের ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৬৭৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ইডিএফের ঋণ দেওয়া আছে ২৪৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার। তাদের এডিআর ৮৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি ব্যাংক আল-ফালাহ সীমা অতিক্রম করে ঋণ দিয়েছে ৮৮ শতাংশের ওপরে। ব্যাংকটি এক হাজার ৪১ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ৯৩৫ কোটি টাকা।
ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ১০০ টাকার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৯২ টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও পাঁচটি ব্যাংক এ সীমা লঙ্ঘন করেছে। এর মধ্যে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের এডিআর রেশিও দাঁড়িয়েছে ৯৬.৬৫ শতাংশ। ব্যাংকটির আমানত ৩৭ হাজার ১১ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের জমা আছে দুই হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। তারা বিনিয়োগ করেছে ৪২ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইডিএফ থেকে অর্থায়ন করেছে তিন হাজার ৭০৩ কোটি টাকা।
ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আমানত ৪৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের জমা আছে এক হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। তারা বিনিয়োগ করেছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ইডিএফ থেকে অর্থায়ন করেছে এক হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটির এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯৪.২১ শতাংশ।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এডিআর ৯২ দশমিক ১৫ শতাংশ। তাদের আমানত ১০ হাজার ৯২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বিনিয়োগ ১০ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।
ইউনিয়ন ব্যাংকের আমানত ১৭ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা তিন হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। তাদের বিনিয়োগ ১৯ হাজার কোটি টাকা। ইডিএফ থেকে তারা অর্থায়ন করেছে ২১৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯৬.২০ শতাংশ।
পূবালী ব্যাংকের শরিয়াহ শাখায় আমানত ৫৭১ কোটি টাকা। তাদের নিজস্ব আমানত ৫২ কোটি টাকা। তারা বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী আমানতের ৯২ শতাংশ বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও তারা করেছে ৯৬ দশমিক ১৪ শতাংশ।
এসআই/এমএআর/