মহামারি করোনায় সৃষ্ট অর্থনীতির সঙ্কট মোকাবিলায় বিশেষ সুবিধা এবং নানা ছাড়ের ফলে কাগজে-কলমে কমেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। গেল ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি বা মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি ৬ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। খেলাপির ঋণের এ পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ হাজার ৫৯৭ কোটি ২৬ হাজার টাকা কম।

মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি ৬ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কিন্তু তিন মাস আগেও খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

এর আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ কমেছে ৫ হাজার ৫৯৭ কোটি ২৬ হাজার টাকা। এর আগে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ঋণগ্রহীতা ঋণের কি‌স্তি শোধ না করলেও তা‌কে খেলাপির তালিকায় দেখানো যাবে না, ২০২০ সালজুড়ে এমন সুবিধা পেয়েছেন গ্রাহক। এছাড়া খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল, পুনঃগঠনে বিভিন্ন নীতিমালার শর্তে শিথিলতা আনা হয়। এতে করে গত এক বছরে ঋণের কিস্তি না দিয়েও নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। অন্য দিকে কিছু উদ্যোক্তা ঋণ শোধও করেছেন। যার কারণে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ কমেছে। করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসায় ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হচ্ছে। খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা এবং নানা ছাড় শিথিল করা হচ্ছে। এতে করে আগামীতে খেলাপির প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে। ব্যাপক হারে বাড়বে ব্যাংক খাতের মন্দ ঋণের পরিমাণ।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন সুবিধার কারণে খেলাপি ঋণ কমে এসেছে এটা ইতিবাচক। তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার কোটি টাকা, পরিমাণটাও কিন্তু অনেক। খেলাপির এ পরিমাণ কাগজে কলমে, কিন্তু বাস্তবে এ পরিমাণ আরও বেশি হবে।

সাবেক এই গভর্নর আরও বলেন, এখন খেলাপিদের অনেকেই ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নতুন করে প্রণোদনার ঋণ নিতে চাচ্ছেন। ফলে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে কিছু টাকা আদায় হয়েছে, এটা খুব বেশি বলা যাবে না। তাছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণ আদায়ে শিথিলতা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময় শেষে মোট খেলাপি কমলেও আগামী বছর বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

এদিকে ডাউনপেমেন্ট (এককালীন জমা) ছাড়াই চলমান ঋণ তিন বছর মেয়াদে পুনঃতফসিলের সুযোগ এবং করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সময় আরও বাড়ানোর দাবি করেছেন ব্যাংক মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (বিএবি)। তাদের এ দাবি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ব্যাংক পরিচালকদের নেতাদের এসব দাবি মেনে নিলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের আসল চিত্র আড়ালেই থেকে যাবে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলো ২ লাখ ২ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ৪২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৯৭১ কোটি। তাদের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ৫৮ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে বাংলাদেশে কর্মকাণ্ড চালানো বিদেশি ব্যাংকগুলো। তাদের খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। ৩০ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা বিতরণ করেছে বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংক। এর বিপরীতে খেলাপি ঋণ হয়েছে ৪ হাজার ৬১ কোটি টাকা।

এসআই/এনএফ