১০ হাজার টাকায় শুরু, তানিয়া এখন চার শোরুমের মালিক
পাঁচ বছর আগে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করেন তানিয়া আক্তার। অন্য আট-দশজনের মতো চাকরির চিন্তা করেননি। মাত্র ১০ হাজার টাকায় ব্যবসা শুরু করেন। এখন তিনি একটি ছোট কারখানা ও চারটি শোরুমের মালিক।
দেশের পাশাপাশি বিদেশেও পণ্য রফতানি শুরু করেছেন তানিয়া। কর্মসংস্থান হয়েছে অর্ধশত মানুষের, যাদের বেশির ভাগই নারী। তার স্বপ্ন নারীদের জন্য কিছু করা। সেই স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন ই-কমার্স ব্যবসায়ী তানিয়া।
বিজ্ঞাপন
দেশীয় বুটিকস দিয়ে ২০১৭ সালে ব্যবসায় পথচলা শুরু তানিয়ার। সেই থেকে ক্রেতাদের পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী ভারতীয় ও পাকিস্তানি থ্রি পিস, টুপিস, লেহেঙ্গা ও কুর্তির মতো পণ্য বিক্রি করছেন, যাতে রয়েছে ৫০-৬০ ধরনের ডিজাইন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘কালার্স হিল’ নামে একটি পেজের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। পেজটিতে রয়েছে সাত লাখের বেশি ফলোয়ার। পাশাপাশি চারটি শোরুমে মেয়েদের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছেন।
করোনাকালে মানুষ যখন দিশেহারা, লকডাউনে গৃহবন্দি, তখন তানিয়ার পেজে অনেক অর্ডার আসে। তখন দিন-রাত পরিশ্রম করে অর্ডারের পণ্যগুলো সঠিক সময়ে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ফলে ক্রেতাদের বিশ্বাস অর্জন করেছেন। এগিয়ে গেছেন সামনের দিকে। একপর্যায়ে তিনি হয়ে ওঠেন সফল একজন উদ্যোক্তা।
বরগুনার মেয়ে তানিয়া আক্তার। উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প শুনিয়েছেন ঢাকা পোস্ট-কে। তিনি বলেন, পড়াশোনা শেষে কিছুদিন কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিই। মাথায় এলো কিছু একটা করার। তখন আমরা বাসাবোতে থাকি। স্বামীর অনুপ্রেরণায় এক বান্ধবীকে নিয়ে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে এক রুমে কাজ শুরু করি। ১৫ হাজার টাকার মধ্যে আমার ছিল ১০ হাজার টাকা আর বান্ধবীর পাঁচ হাজার টাকা।
তানিয়া বলেন, শুরুটা হয় বুটিকের মাধ্যমে। শুরুতে আমরা পুরান ঢাকার ইসলামপুর থেকে কাপড় কিনে বাসায় বসে ডিজাইন করি। নিজের ব্যবসার প্রথম কাস্টমার আমি নিজেই। আমার জামা দেখে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধুরা কিনতে আগ্রহ দেখান। তাদের কাছে বিক্রিও শুরু করি। মেয়েদের পছন্দ ও চাহিদা সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল, সেটাই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিই।
‘প্রথম দিকে ১৪-১৫টা পোশাকের ডিজাইন করি। এসব বিক্রি হয়ে গেলে আরও ৩০টি পোশাক তৈরি করি। এভাবেই শুরু। এক-দেড় মাসের মধ্যে ব্যবসা বড় হতে শুরু করে। পরিসর বেড়ে যাওয়ায় আরও দুটি বাসা ভাড়া নিই। এক দিন আমাদের কিছু ডিজাইন নিয়ে নিউ মার্কেট ও ধানমন্ডির কয়েকটি শোরুমে দেখাই, তাদের পছন্দ হয়। তখন শোরুমের মালিকরা আমাদের কাছে পোশাক অর্ডার করতে থাকেন। আমাদের কাজের পরিধি বাড়তে থাকে।’
হঠাৎ বাসার নিষেধাজ্ঞায় বান্ধবী কাজ বন্ধ করে দিলে স্বামীর সহযোগিতায় একাই নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন তানিয়া। বলেন, অর্ডার বেশি হওয়ায় বাসাবোতেই একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে কারখানা হিসেবে ব্যবহার করতে থাকি। দুটি মেশিন দিয়ে শুরু হওয়া কারখানাটি বড় হয়। মেশিন ও লোকবল বাড়তে থাকে।
“ব্যবসা শুরুর এক বছর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘কালার্স হিল’ নামে একটি বিজনেস পেজ খুলি। নিজের তৈরি পোশাক অনলাইনে বেশ ভালো সাড়া ফেলে। কিছুদিন পর ঢাকার শান্তিনগরে ইস্টার্ন প্লাস শপিং কমপ্লেক্সে একটি শোরুম নিই। ধীরে ধীরে মার্কেট বুঝতে শুরু করি। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী একসময় ভারত-পাকিস্তান থেকে পণ্য এনে বিক্রি শুরু করি। এখন আমার ব্যবসার ৭০ শতাংশ পণ্যই হচ্ছে ভারতীয়, বাকি ২০ শতাংশ পাকিস্তানি, ১০ শতাংশ দেশীয়।”
ইন্ডিয়ান পণ্যের মধ্যে দিল্লি বুটিকস, গোটাপাতি, স্টোন কামিজ, জয়পুরী ও রামছা জনপ্রিয়। এছাড়া সারারা-গারারা, তাওয়াক্কাল, খুব সুরত পাকিস্তানি পণ্যও জনপ্রিয়। আমাদের পণ্যের মান, সেবা ও সততা সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে— বলেন তানিয়া।
চাকরি না করে কেন ব্যবসায় এলেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তানিয়া বলেন, পড়াশোনা শেষ করে আমার কাছে মনে হলো চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই কিছু করতে পারি। এতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আমি যখন অনলাইনে ব্যবসা শুরু করি তখন অনেকেই এ সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতেন না। আমার পরিচিতদের অনেকেই বলেছেন, তুমি সময় নষ্ট করছ, এসব বাদ দিয়ে একটা ভালো চাকরি কর। আমি তাদের বলি, দেশের বাইরে অনলাইন ব্যবসা অনেক জনপ্রিয়। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে আমাদের দেশেও অনলাইন নির্ভরতা দিনদিন বাড়বে।
স্বামী মনিরুজ্জামান সুমন সবসময় পাশে থেকে তানিয়াকে সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন শিক্ষিত নারী হয়ে আমি উদ্যোগটা নিই পরিবারের কথা ভেবে। একজন নারী হিসেবে আমি চেয়েছি অন্য নারীদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে। এ কাজে আমার স্বামী পাশে থেকে সাহায্য করেছেন। বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠানে অর্ধশতাধিক সহকর্মী রয়েছেন। তাদের ৭০ শতাংশই নারী।
করোনাকালের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, করোনার থাবায় যখন ব্যবসা-বাণিজ্য বিপর্যস্ত, তখন কঠোর পরিশ্রম করেছি। মহামারির মধ্যে আমার একজন কর্মীকেও ছাঁটাই করতে হয়নি। সবাইকে সঠিক সময়ে বেতন দিয়ে চালিয়ে নিয়েছি। ব্যবসাও বেশ হয়েছে।
‘করোনার আগে আমার এক শ্রেণির ক্রেতা ছিল। এর আগে প্রায় দুই বছর ব্যবসা করেছি। তখন আমার পেজে লাইক ছিল আড়াই লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে অনেকেই আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। তারাই আমাকে করোনার সময় অনেক বেশি সাপোর্ট দিয়েছেন। তারা লাইভ শেয়ার করেছেন, বন্ধুদের বলেছেন আমার পেজ থেকে পণ্য কিনতে। কাস্টমারদের ৯৯ শতাংশই আমার প্রতি পজিটিভ।
এখন আমার কাছে চার কোটি টাকার পণ্য রয়েছে। আজ আমার ‘কালার্স হিল’ ফেসবুক পেজটি দেশে এবং দেশের বাইরের অনেকেই ফলো করেন। ঢাকাসহ দেশের সব জেলা ও উপজেলায় প্রোডাক্ট ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রেতারা অনলাইনের মাধ্যমে আমাদের প্রোডাক্ট অর্ডার করছেন। বর্তমানে আমার চারটি শোরুম আছে, যার মধ্যে তিনটি শান্তিনগরের ইস্টার্ন প্লাস শপিং কমপ্লেক্সে এবং একটি বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে। এর মধ্যে দুটি শোরুম নিজস্ব। আর দুটি ভাড়া করা।
নতুন করে কোনো নারী উদ্যোক্তা হতে চাইলে কী পরামর্শ দেবেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেকোনো ব্যবসার শুরুতে বাধা-বিপত্তি আসবেই। আমার জন্য পথটা সহজ হয়েছে কারণ, স্বামীর সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি। নতুন যারা আসবেন, তাদের জন্য পরামর্শ হলো- ব্যবসার শুরুতে মান, ডিজাইন ও ভোক্তার সন্তুষ্টির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে, ভোক্তার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।
এমআই/আরএইচ