কথা ছিল ভাষার মাসেই মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়াবে ভাষা আন্দোলনের ‘শ্রদ্ধাস্মারক’ দেশের প্রথম শহীদ মিনার। ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যেই রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাস এলাকায় পুনর্নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল। পাইলিংও হয়েছে প্রায় বছর দুয়েক আগে। অর্থ বরাদ্দ জটিলতাও কেটেছে। তবুও চার বছরেও শ্রদ্ধাস্মারক নির্মাণ শেষ করতে পারেনি রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক)।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছিলেন, সব জটিলতা কেটে গেছে। ওই মাসেই তারা নির্মাণকাজ শুরু করবেন।

বছর ‍ঘুরে ফের এসেছে ভাষার মাস। কিন্তু কাজের এক চুলও অগ্রগতি নেই। প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণকাজের অগ্রগতি জানতে ২০ ফেব্রুয়ারি ফের প্রকৌশলী শরিফুল ইসলামের দপ্তরে ঢাকা পোস্ট। কিন্তু এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি। উল্টো দেখিয়ে দেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নূর ইসলামকে। প্রকল্পকাজ পরিদর্শনে বাইরে থাকায় তাকেও দপ্তরে পাওয়া যায়নি। তবে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের অগ্রগতি প্রসঙ্গে নূর ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সংশোধিত বড় প্রকল্পের সঙ্গে তারা এই কাজটি ধরেছেন। এখন সেটি করতে একটু দেরি হবে। ছয়-সাত মাসের আগে হবে না।

মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক ওয়ালিউর রহমান বাবু জানান, বায়ান্নের আগে থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা। ঢাকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে তাল রেখে রাজশাহীর ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হতো বৃহৎবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী এ কলেজ থেকেই। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ হয় এই চত্বরেই। এটিই দেশের প্রথম শহীদ মিনার। আমরা এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।

জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের সামনে ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জীবন্ত করে তুলতে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেন রাজশাহী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান। এরপর ২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘটা করে প্রথম শহীদ মিনারের স্থানে শ্রদ্ধাস্মারক নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।

এরপর বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি চালাচালি করেন অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার কাছে। এরপর ২০১৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমানের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে বরাদ্দের চিঠি তুলে দেন এমপি।

প্রথম শহীদ মিনারের স্থলে ৫২ ফুট উচ্চতার নতুন মিনার নির্মাণের কথা ছিল। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর এমপি ফজলে হোসেন বাদশাকে নিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণকাজের উদ্বোধনও করেন মেয়র লিটন। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ জটিলতায় থমকে যায় নির্মাণকাজ। ফিরে যায় সেই বরাদ্দকৃত অর্থ। আবারো অর্থ বরাদ্দ মেলে।

তাছাড়া যে জায়গায় শহীদ মিনার নির্মাণের কথা ছিল সেখানে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। ফলে একটু দূরে সরে গিয়ে রাস্তার পাশে জায়গা নির্ধারণ করা হয়। বছর দুয়েক আগে নির্ধারিত স্থানে পাইলিং সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু উঠে দাঁড়ায়নি অবকাঠামো। এরই মধ্যে রাস্তা সম্প্রসারণের কারণে ছাত্রাবাসের সীমানা প্রাচীর সরিয়েছে নগর কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল খালেক জানান, প্রথম শহীদ মিনারের স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ বেশ আগেই নেওয়া হয়েছিল। সেটির পাইলিং কাজও হয়েছিল। শহীদ মিনার নির্মাণের কারণে ছাত্রাবাসের ডাইনিংটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিন্তু পাইলিং হওয়ার পর আর নির্মাণকাজ গতি পায়নি। কাজটি কি অবস্থায় আছে সেটিও আমাদের জানা নেই। খোঁজ নিতে গেলে সংশ্লিষ্টদের বলতে শুনি শিগগিরই কাজ শুরু হবে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, ওই সময় তাৎক্ষণিকভাবে রাজশাহী কলেজের এই শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। যারা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের দাবি এটিই দেশে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। ফলে এই শহীদ মিনার রাজশাহীর সাধারণ মানুষের কাছে প্রথম শহীদ মিনারের স্বীকৃতি পেয়েছে।

অধ্যক্ষ আরও বলেন, রাজশাহী কলেজের যে ইতিহাস, সেখানে এই শহীদ মিনারের কথা উল্লেখ আছে। এটি যে রাজশাহী কলেজের ইতিহাসে প্রথম শহীদ মিনার সেটিও বলা আছে। রাজশাহী কলেজকে জানতে গেলে এই শহীদ মিনারকেও জানা হয়ে যায়।

রাজশাহীর ভাষা সৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী কলেজ মুসলিম ছাত্রাবাসের প্রধান ফটকের পাশে দেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে সেটি তৎকালীন পুলিশ বাহিনী গুঁড়িয়ে দেয়। এটিই বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার, যা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। জীবদ্দশায় এই শহীদ মিনারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান এই ভাষা সংগ্রামী।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এসপি