অভাবের সংসার ছিল মিজানদের। পাঁচ ভাই ও ছয় বোনসহ মোট ১৩ সদস্যের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতেন বাবা মৃত কারির উদ্দীন। অভাবের কারণে ঠিকমতো তিনবেলা খাবারও জুটত না তাদের। এমন পরিস্থিতিতে অন্যের বাড়িতে কাজ করে বাবাকে সহযোগিতা করেছেন মিজান। অভাবে পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। এরপর বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন পাঁচ ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে পঞ্চম মিজানুর রহমান মিজান। কাউকে না জানিয়েই পাড়ি জমান ঢাকায়। এরপর ১৯৯৬ সালে ঠাঁই নেন মালয়েশিয়ায়। এখন তিনি দেশটির শিল্পপতিদের একজন।
 
মিজান ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রহিমানপুর ইউনিয়নের উত্তর হরিহরপুর গ্রামের মৃত কারির উদ্দীনের ছেলে।

১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়ে মিজান নিমার্ণশ্রমিক হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন। এর কিছুদিন পর একটি ইলেক্ট্রনিক কোম্পানিতে কাজ নেন তিনি। সেখান থেকে তিনি মালয়েশিয়ার পেনাং প্রদেশের একটি জুস ফ্যাক্টরিতে প্রায় তিন বছর কাজ করেন।

মিজান বুঝেছিলেন স্বল্প সময়ে নিজের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য ব্যবসা হতে পারে সেরা মাধ্যম। তাই তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে কুয়ালালামপুর থেকে ৫৫০ কিলোমিটার দূরে কেলান্তান প্রদেশে চলে আসেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশি একজনের দ্বারা প্রতারণা ও পুলিশ হয়রানির শিকার হন। পরে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তিনি কেলান্তানে প্রায় শূন্য হাতে একটি কনস্ট্রাকশন সাইটে আবারো শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে তিন বছর কেটে যায় তার।

নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করলেও নিজের দক্ষতা ও পরিশ্রমে তিনি আজ এ সেক্টরের শীর্ষদের একজন। এক সময় অর্থাভাবে দিনাতিপাত করা মিজানুর রহমান এখন ‘দাতো’ মিজান। তিনি এখন দেশটির বিশিষ্ট শিল্পপতি। গড়ে তুলেছেন একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান। পেয়েছেন দেশটির রাজা কর্তৃক প্রদত্ত সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মানিত খেতাব ‘দাতো’। মালয়েশিয়ায় এ ধরনের খেতাব শুধুমাত্র বিশিষ্টজনরা পেয়ে থাকেন।

মিজানুর রহমান সেখানে গড়ে তুলেছেন বৃহৎ গ্রুপ প্রতিষ্ঠান মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্স। পরিস্থিতির কারণে নিজে স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। অথচ বর্তমানে তার অধীনেই কাজ করছেন মালয়েশিয়ার সিভিল বিএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারসহ উচ্চ শিক্ষিতরা। 

মিজানের কোম্পানিতে কর্মরত বেশির ভাগই বাংলাদেশি। মিজান গ্র্যান্ড ইন্টার ট্রেডার্সের অধীনে সরকারি ও বেসরকারি ৮টি নির্মাণ সেক্টরে প্রায় শতকোটি টাকার কাজ চালু রয়েছে। এসব সেক্টর পুরোদমে চালু রাখতে আরো ২ হাজার কর্মী দরকার। মিজান ইতোমধ্যে কলিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী আনার জন্য দূতাবাসে চাহিদাপত্র জমা দিয়েছেন। দূতাবাস সরেজমিনে তদন্ত করে এর সত্যতাও পেয়েছেন। 

মিজানের এই আকাশচুম্বী সাফল্যে যে কেউ ঈর্ষান্বিত হতেই পারেন। পাশাপাশি শূন্য হাতে মালয়েশিয়ার একজন নির্মাণশ্রমিক থেকে দাতো মিজান সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহণের কাহিনী হতে পারে বাংলাদেশিদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। লাখ লাখ প্রবাসী ও বেকার যুবকদের মধ্যে কর্মস্পৃহা জাগানোর জন্য জিরো থেকে হিরো হওয়া দাতো মিজানের কর্মজীবনের নীতি-আদর্শই যথেষ্ট। 

মিজানের বড় ভাই আবু তাহের ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলা দারিদ্র্যের কারণে মিজান আমাদের না জানিয়ে ঢাকা চলে যায়। তারপর কয়েক বছর সে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। পরে জানতে পারি সে মালয়েশিয়া গেছে। সেখানে দীর্ঘদিন থেকে আজ সে শিল্পপতি। সে খেতাব পাওয়ায় আমরা খুব খুশি হয়েছি।

মিজানের ছোট ভাই মো. সোহাগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিজান আমার বড় ভাই। ছোটবেলায় দেখেছি বাবা খুব কষ্ট করে সংসার চালাতেন। মিজান ভাইও অনেক পরিশ্রম করত। সংসারের এমন অবস্থা দেখে উনি কাজের জন্য ঢাকায় যান। পরে ঢাকা থেকে মালেশিয়া গিয়ে আজ সফল হয়েছেন। আমাদের পরিবারের সবাইকে তিনি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন।

মিজানের মা জোলেখা বেগম বলেন, আমার ৫ ছেলে ও ৬ মেয়ে। সব মিলিয়ে ১৩ জনের সংসার ছিল। বড় সংসার হওয়ায় অভাব লেগেই থাকত। সব ছেলেরা অন্যের বাসায় কাজ করত। মিজান আমার অনেক ভদ্র ছিল। অভাবের কারণে সেও পড়াশোনা করতে পারেনি। এক দিন রাগ করে সে ঢাকা চলে যায়। ঢাকা থেকে পরে মালয়েশিয়ায় যায়। আমরা অনেকদিন পর তা জানতে পারি। ওই দিকেই সে বিয়ে করেছে। এখন সে উপাধি পেয়েছে। সে আমাদের সবার ভরণ-পোষণ চালায়। এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ করে। মিজান উপাধি পাওয়ায় আমি অনেক খুশি। আল্লাহ আমার ছেলেকে ভালো রাখুক।

এ বিষয়ে রহিমানপুর ইউপির ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য ফজলে রাব্বি বলেন, তিনি অনেক পরিশ্রম করে আজকে একটি ভালো জায়গায় স্থান করে নিয়েছেন। অভাবে কারণে এলাকা ছাড়া মিজান এখন এলাকার মসজিদ, মাদরাসা ও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করে যাচ্ছেন। সমাজের অসহায়-দুঃস্থ মানুষদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মেধা আর পরিশ্রম করলে মানুষ সফল হতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মিজান।  

এ বিষয়ে মালয়েশিয়া থেকে ফোনে মিজানুর রহমান মিজান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বড় পরিবার ছিল। পাঁচ ভাই ও ছয় বোন। ছোটবেলায় দেখেছি, সংসার চালাতে বাবাকে অনেক কষ্ট করতে হতো। তাই স্কুলের গণ্ডি পার হওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে আমি বাসা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসি। পরে ঢাকা থেকে মালেশিয়ায় আসি। এখানে আসার পর নিমার্ণশ্রমিক হিসেবে আমার যাত্রা শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে আমার অবস্থার পরিবর্তন আসে। বর্তমানে আমার অধীনে প্রায় ২০০ জন মানুষ কাজ করছেন। 

তিনি আরো বলেন, ২০১৬ সালে আমি মালয়েশিয়ার পাহাং-এর রাজার একটি মিউজিয়াম করি। সেই মিউজিয়ামের কাজ দেখে রাজা খুব মুগ্ধ হন। পরে আমাকে ‌‘দাতো’ খেতাবে ভূষিত করেন। 

ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগত জীবনে মালেশিয়ায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। আমার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা পড়াশোনা করছে। 

মেধা, পরিশ্রম আর সততা থাকলে সমাজে জিরো থেকে হিরো হওয়া সম্ভব। যার দৃষ্টান্ত আমি নিজেকে মনে করি। এক সময় আমার ও পরিবারের কিছুই ছিল না। অন্যের বাসায় কাজ করতাম। আজকে আমার আওতায় মানুষ কাজ করে বলেও জানান তিনি।

আরআই/এমএএস