শেরপুরে অসহায় ক্ষুধার্তদের জন্য ‘অনাহারির আহার’
শেরপুর জেলা শহরে অসহায়দের জন্য প্রতিদিন বিনামূল্যে একবেলা খাবার কর্মসূচির আয়োজন করেছে একটি সংগঠন। যা ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। নৃ ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় গত বছরের ১৫ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এ কর্মসূচি শুরু হয়। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অনাহারির আহার’।
যেখানে প্রতিদিন জেলা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ৫০ থেকে ৬০ জন অসহায় ক্ষুধার্তদের বিনামূল্যে দুপুরের খাবার খাওয়ানো হয়। পরিপাটি পরিবেশে অনাহারিদের মাঝে খাবার পরিবেশন করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) শেরপুর শহরের পৌর ঈদগাহ মাঠে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বিজ্ঞাপন
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আওরঙ্গজেব আকন্দ বলেন, আমি শেরপুরের সন্তান। গত বছরের করোনা মহামারিতে যখন অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে, অনেক পরিবারে যখন খাবারের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, ঠিক সেই সময়ে আমরা ‘অনাহারির আহার’ কর্মসূচি শুরু করি। তখন আমাদের পরিকল্পনা ছিল একবেলা হলেও ক্ষুধার্ত মানুষদের জন্য সুষম খাবারের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা প্রতিদিন এখানে দুপুরে ৫০ থেকে ৬০ জন নারী-পুরুষকে খাবার খাওয়াই।
যেখানে থাকে ডিম, ডাল, সবজি ও ভাত। প্রথমে এটি ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু হলেও। এখন এই কর্মসূচিতে অনেকেই আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন। শুধু তাই নয়, শুরুতে অনুদান গ্রহণ শেরপুর জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে ‘আনাহারির আহার’ কর্মসূচির জন্য অনুদান আসে।
এছাড়াও অনেক ধনাঢ্য পরিবার তাদের বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, বিয়ে, মৃত্যুবার্ষিকীতে এই কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকেন। এজন্য প্রতিমাসে অন্তত ১০ থেকে ১২ দিন ‘অনাহারির আহার’ নামে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে মুরগি, গরুর গোশত ও পোলাও থাকে। ইতোমধ্যে শেরপুর পৌরসভার মেয়র আলহাজ গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া লিটন দুই দফায় ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন। এছাড়াও শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ আমাদেরকে ৪ টন চালের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
চাকরিজীবী মঞ্জুরুল করিম শামীম বলেন, আমরা যে যেখানেই থাকি, শেরপুরের মানুষের কথা ভাবি। অসহায়ের সহায় ও অনাহারির আহার এই দুটি কর্মসূচিতে পৃষ্ঠপোষকতা করছে নৃ ফাউন্ডেশন। দীর্ঘ ৫৫১ দিন ধরে আমরা প্রতিদিন অনাহারির মুখে খাবার তুলে দিতে পেরেছি। এ কর্মসূচিতে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। এজন্য আমরা শেরপুরের সব ধরনের শ্রেণি-পেশার মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রায় সবাই আধুনিক জীবনযাপনে ব্যস্ত। উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা তাদের জন্মদিনে বন্ধুদের নিয়ে পার্টি করে। কিন্তু আমরা এই কর্মসূচি চালু করার পর অধিকাংশ তরুণ-তরুণী তাদের জন্মদিন অসহায়দের সঙ্গে পালন করে। গত কয়েকদিন আগে আমাদের শেরপুরের জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদের সহধর্মিণী জান্নাতুল ফেরদৌস প্রিয়া অনাহারীদের সঙ্গে তাদের বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করেছেন। এই কর্মসূচি থেকে আগামী প্রজন্ম অনেক কিছু শিখবে। তারা ভবিষ্যতে মানবতার কল্যাণে কাজ করার উৎসাহ পাবে।
মঞ্জুরুল করিম শামীম বলেন, এখন পর্যন্ত জেলা প্রশাসন, শেরপুর পৌরসভা, উপজেলা প্রশাসন, জেলার শিল্পপতি, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে। অদূর ভবিষ্যতে ‘অনাহারির আহার’ আরও বৃহৎ পরিসরে করার পরিকল্পনা আমাদের আছে।
অননাহারির আহার কর্মসূচিতে খাবার খেতে আসা জমিলা বেগম বলেন, আমার এই দুনিয়ায় কেউ নেই। বাবা-মা মারা গেছেন অনেক আগে। স্বামীও মারা গেছেন। একটি মাত্র মেয়ে, সে স্বামীর সঙ্গে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে থাকে। পুরো শরীরে বাতের ব্যথা। চোখ মুখ মাঝে মধ্যে ফুলে যায়। শরীরে শক্তি নেই বললেই চলে। তাই বাসা বাড়িতে কাজ করতে পারি না। প্রতিদিন এখানে এসে খাই। খেয়ে যাওয়ার পর রাতে আর খাওয়া হয় না। অনাহারির আহার না থাকলে হয়তো আমাদের না খেয়ে থাকতে হতো।
বশির মিয়া নামে একজন বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। আমার স্ত্রী বিছানায় শয্যাশায়ী। সে এখানে খাবার খেতে আসতে পারে না। নিজে পঙ্গু শরীর নিয়ে চলতে পারি না। কাজ করে টাকা উপার্জন করব কীভাবে? তাই সকালে না খেয়ে বের হয়ে এদিক সেদিক ভিক্ষা করি। দুপুরে আনাহারির আহারে খাই। যাওয়ার সময় কয়ডা ভাত বউয়ের জন্য নিয়ে যাই। রাতে আবার না খেয়েই আমাদের স্বামী-স্ত্রীকে শুয়ে পড়তে হয়।
এ বিষয়ে শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা আনন্দের যে এখনো মানবিকতা বেঁচে আছে। সমাজের বিত্তবান মানুষেরা অসহায়দের কথা ভাবেন। নৃ ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনাহারির আহারে প্রতিদিন অসহায় কর্মহীন, নারী-পুরুষ ও ভিক্ষুকরা খাবার খেতে আসেন। আমি শেরপুরে দায়িত্ব নেওয়ার পরই তাদের বিষয়ে জানতে পেরেছি। এজন্য শেরপুর জেলা প্রশাসন থেকে তাদের জন্য ৪ টন চালের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এছাড়াও তারা যতদিন কার্যক্রম পরিচালনা করবে, আমরা ততদিন অনাহারির আহারের চালের ব্যবস্থা করে দিব।
তিনি বলেন, এভাবে যদি সবাই অসহায়দের পাশে দাঁড়াত, তাহলে আমাদের সমাজে অনেকের দুঃখ দুর্দশা কিছুটা হলেও কমে যেত।
জাহিদুল খান সৌরভ/আরএআর