ফুলে রঙিন আমবাগান
ঋতুচক্রে আসছে ফাল্গুন। এরই মধ্যে বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলের আমবাগানগুলোতে আসতে শুরু করেছে মুকুল। আর ক’দিন পরেই মুকুলের ভারে নুয়ে পড়বে আমগাছ। এরপর থোকায় থোকায় ঝুলবে আম। এটিই এ অঞ্চলের চিরায়ত দৃশ্যপট। কিন্তু এবার রাজশাহীর আমগাছে থরে থরে ঝুলছে বাহারি রঙের ফুল।
কেবল আমগাছে ফুল নয়, আমবাগানে ফুটেছে ভিনদেশি টিউলিপও। ‘ড্রিমার্স গার্ডেন’ নামের এই আমবাগানটি একেবারেই হয়ে উঠেছে ফুলবাগান। কৃষি উদ্যোক্তা হাসান আল সাদী পলাশের এই উদ্যোগ এই অঞ্চলজুড়ে কৃষি পর্যটনে দিন বদলের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
দৃষ্টিনন্দন এই আমবাগানটির অবস্থান রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ দামকুড়ার পলাশবাড়িতে। রাজশাহী নগরী থেকে এই বাগানটির দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। রাজশাহী নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা-কাঁকনহাট সড়ক হয়ে মিনিট দশেকের পথ। ফুলের টানে প্রতিদিনই বাগানে আসছেন ফুলপ্রেমীরা। জনপ্রতি ৫০ টাকা প্রবেশমূল্য দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে ফুলের রাজ্যে।
প্রধানফটক থেকে শুরু করে বাগানজুড়ে কেবল ফুল আর ফুল। সারি সারি আমগাছের ডালেও টবে ঝুলছে বাহারি ফুল। গাছের নিচে-ফাঁকা জায়গায় সবখানেই থরে থরে ফুটে রয়েছে ফুল। বাদ যায়নি পুকুরপাড়ও। পুকুরে ভাসছে ফুলের তরী। যে কেউ অনায়াসে হারিয়ে যেতে পারেন ফুলের রাজ্যে।
এখানকার টিউলিপে বুঁদ তাবাসসুম ফেরদৌস সারা। মায়ের সাথে টিউলিপ বাগান দর্শনে এসেছিল সে। বাগানে ঢুকেই সফেদ ডানা প্রজাপতিরমতো সারা উড়ে বেড়িয়েছে এ ফুল ও ফুল। সারা জানায়, সে অনেক রকমের ফুল দেখেছে। সাথে টিউলিপ ফুলও দেখেছে সে। সাদা টিউলিপ মন কেড়েছে তার। ঘুরে ঘুরে ফুলের সাথে ইচ্ছেমতো ছবিও তুলেছে।
পুকুরে ফুলের নৌকায় মা সাঈদা রায়হানার সাথে ভেসেছে সারা। বাগানে এসে মেয়ের মতো মাও অভিভূত। সাঈদা রায়হানা জানিয়েছেন, রাজশাহীর অনেক জায়গায় তারা ঘুরেছেন। কিন্তু এমন পরিপাটি ফুলবাগান তিনি পাননি। এক কথায় ফুলের রাজ্য তার মন কেড়েছে। বাগানের টিউলিপ ফুলও তার অসাধারণ লেগেছে। টিউলিপে এই অঞ্চলের দিনবদলের হাতছানি দেখছেন এই ফুল প্রেমী।
বাগানের উদ্যোক্তা হাসান আল সাদী পলাশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর সদরের পুরাতন বাজার এলাকার বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ধরেই আমচাষ এবং ব্যবসায় যুক্ত তিনি। এই উদ্যোগের আদ্যপান্ত নিয়ে কথা হয় এই স্বপ্নচারীর সাথে। পলাশ জানান, পুকুরসহ তেরো বিঘার আমবাগানটিতে সাড়ে ৩ শ বিভিন্ন জাতের আমগাছ রয়েছে।
আমের তিন মাস বাদে বাকি সময়টাজুড়ে বাগানটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতো। এই সময়টা কী করে কাজে লাগানো যায় সেই বিষয়টি নিয়ে তারা ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ফুলবাগান তৈরির বিষয়টি মাথায় আসে। এই ভাবনা থেকে তারা ছোটো পরিসরে এই বছর ফুলবাগান তৈরি করেছেন। আসছে বছর আরও বড় পরিসরে ফুলবাগান করার পরিকল্পনা জানান এই উদ্যোক্তা।
কেবল মনের জোরেই এ উদ্যোগের শুরু বলে জানিয়েছেন পলাশ। তিনি বলেন, আমবাগানে ফুলচাষ নিয়ে অনেকের সাথেই অনেকভাবে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু সবাই নেতিবাচক কথাবার্তা বলেছেন। একরকম মনের জোরে এই বছর ফুলবাগান তৈরি করেছি। এই সফলতা আমাদের নতুন করে পথে দেখাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের গাঁদা, পিটুনিয়া ও সেলোশিয়াসহ পরিচিত কিছু ফুল নিয়ে আমরা কাজ শুরু করি। একপর্যায়ে জানতে পারি, দেশে টিউলিপ ফুল চাষ হচ্ছে। প্রথমিকভাবে ১ হাজার বাল্বের টিউলিপ বাগান গড়ে তোলা হয়। এতে আংশিক সফলতাও এসেছে। এটি আমাদের পরীক্ষামূলক চাষ। টিউলিপ যেহেতু বছরজুড়েই ফোটে। এটি ধরে রাখা গেলে বছরজুড়েই আমবাগানে ফুল পাওয়া সম্ভব। এতে বিনোদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।
পলাশ বলেন, বাগানে প্রতিদিনই দর্শনার্থী আসছেন। তারা আমাদের নানানভাবে উদ্বুদ্ধ করছেন। তারা চাইছেন এখানে ছোটো পরিসরে পিকনিক স্পট হলে ভালো হয়। সাথে ছোটো একটা ক্যাফেও চাইছেন দর্শনার্থীরা। আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ে সেই লক্ষ্য ছিল না। ফলে আমরা এ বছর সেটা রাখতে পারিনি। আগামী বছর দর্শনার্থীদের চাহিদামতো বাগানটি পরিপাটি করে সাজিয়ে তুলতে পারব।
বাগান সাজাতে ভিন্নতা আনা হয়েছে উল্লেখ করে উদ্যোক্তা জানান, এখানে ছোটো একটি পুকুর রয়েছে। পুকুরের প্রকৃতি বিনষ্ট না করে সেটি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বাগানের আমগাছগুলোতে থোকায় থোকায় ঝোলোনো হয়েছে নানান রঙের ফুল। আগামীতে প্রতিটি আমগাছে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হবে। আমবাগান নয়, উদ্যোক্তার চাওয়া এটি ফুলবাগান হিসেবেই পরিচিত পাক।
পলাশ আরও জানান, বাগানের চারপাশে বিস্তীর্ণ ফসলি খেত। যেটা প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে সেজে ওঠে। শীতকালে দিগন্তজোড়া সরিষা খেত। সরিষা ওঠার পর সেখানে ধান চাষ হয়। ওই সময়টা পুরো এলাকায় হয়ে ওঠে সবুজ। বাগানে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বসানো হয়েছে। যাতে হলুদ কিংবা সবুজ সমুদ্রে ডুব দেওয়া যায়।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দপ্তর বলছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ এবং নাটোর জেলায় ২০১৯-২০ মৌসুমে আমবাগান ছিল ৮১ হাজার ১৫ হেক্টর। ওই মৌসুমে আমের ফলন হয়েছে ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৬৯৮ টন। এ বছর আমবাগানের পরিধি আরও বেড়েছে। আমবাগানে সাথি ফসল চাষ কিংবা ফুলবাগান গড়ে উঠলে এই অঞ্চলের অর্থনীতির গতিপথ পাল্টে যাবে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিন বলেন, সাধারণত আমবাগানে আদা-হলুদ চাষ হয়ে থাকে। কয়েক বছর ধরে সরিষা এবং মুশুর চাষ নিয়ে গবেষণা চলছে। এগুলোর ফলনও ভালো। তবে আমবাগানে ফুলচাষের তথ্য তাদের কাছে নেই। আমগাছ ছোটো থাকা অবস্থায় ফুলসহ যেকোনো ফসলই চাষ হতে পারে। তাতে আমের কোনো ক্ষতি নেই। আমবাগানে সাথি ফসল চাষ অবশ্যই এই অঞ্চলের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস হোসাইন বলেন, আজকাল মানুষের ইকো-ট্যুরিজমে ঝোঁক বাড়ছে। এখানে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত তাদের সাথে অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনছে। এ ধরনের উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো সামনে আরও দেখতে চাই।
এই অধ্যাপক আরও বলেন, অর্থনীতির ভাষায় এগুলোকে আমরা বলি হাইভেল্যু চেইনের প্রোডাক্ট। প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে উদ্যোক্তা। দেশের অর্থনীতি যখন কৃষি অর্থনীতি থেকে বাণিজ্যিক অর্থনীতির দিকে যায়, তখন মানুষ বুঝতে পারে। কোন ফসল উৎপাদন করলে বা কোন খাতে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে তা বুঝতে পারে।
তিনি যোগ করেন, এখানে শুধু ফুল চাষ হচ্ছে না। চাঁপাইনববাবগঞ্জে দেখা যায়, মানুষ আয় বৃদ্ধির জন্য আমবাগানে হলুদের চাষ করছেন। বড় পুকুরের উপর রেস্টুরেন্ট করা হচ্ছে, নীচে আবার মাছও চাষ হচ্ছে। এ ধরনের গ্রামীণ কৃষকরাই তো আমাদের মেরুদণ্ড। এতে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের যে ক্রমবর্ধমান পর্যটন চাহিদা, তাও পূরণ হচ্ছে।
এমএসআর