ভবনটি বিশ্বসেরা খেতাব এনে দেবে ভাবনাতেও ছিল না : কাশেফ মাহবুব
হাসপাতালটিতে নেই কোনো সীমানাপ্রাচীর। ভেতরে ১০ ফুট প্রশস্ত জলাশয়। খানিকটা জায়গা ফাঁকা রেখে এক তলা আর দুই তলা কিছু ভবন। ভবনগুলোতে নেই পলেস্তারা। ইটের গাঁথুনি আর ঢালাইয়ে বানানো দেয়াল ও ছাদ। নিচ দিয়ে বয়ে চলে পানির প্রবাহ। রয়েছে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বিশেষ ব্যবস্থা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়গুলো মাথায় রেখেই কম খরচে এর নকশা করেন হাসপাতালটির স্থপতি ও ঢাকাভিত্তিক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান আরবানা’র পরিচালক কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।
ভবনটি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সোয়ালিয়ায় ফ্রেন্ডশিপ এনজিও নির্মিত প্রথম ‘ভূমি হাসপাতাল’। হাসপাতালটির নাম দেওয়া হয়েছে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল।
বিজ্ঞাপন
বুধবার (২৬ জানুয়ারি) এটি যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (রিবা) ঘোষিত ফলাফলে বিশ্বে কম খরচে ব্যতিক্রমী নকশায় নির্মিত ভবন হিসেবে বিশ্বসেরা খেতাব পেয়েছে।
হাসপাতালটির স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী একজন বাংলাদেশি স্থপতি। তার জন্ম ঢাকায়। তার বাবা ছিলেন একজন প্রকৌশলী। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতক পাস করেন। পরে মধ্যপ্রাচ্য থেকেও স্থাপত্যে ডিগ্রি অর্জন করেন। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও মসজিদ নকশার জন্য ২০১০ সালে স্থাপত্যে আগা খান পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিলেন।
ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে সাতক্ষীরায়ও চলে এসেছে লবণপানি। শুধু মাটির ওপরে নয় নিচেও লবণাক্ততা। এই পানি খাওয়া যায় না, রান্না হয় না আবার গোসলও করা যায় না। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য এই অঞ্চলে অনেকটা যুদ্ধ করে মানুষ। এটি মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এসব কথা চিন্তা করেই ভবনটির নকশা করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস আমাদের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালকে বিশ্বসেরা খেতাব দিয়েছে। পৃথিবীর সব থেকে বড় পুরস্কারের মধ্যে এটি একটি। এটি অর্জনের ফলে খুবই আনন্দিত ও ভালো লাগছে। একটা একক প্রকল্পের জন্য যদি পুরস্কার হয়ে থাকে, তবে এটি বড় পুরস্কার। আমি অভিভূত, আরও বেশি আনন্দিত এ কারণে যে, যে কারণগুলোর জন্য এ পুরস্কারটি দেওয়া হচ্ছে। আমরা সেটি মাথায় নিয়েই কাজটি করেছিলাম। আমাদের চিন্তা-ভাবনাটার তারা স্বীকৃতি দিয়েছেন।
কাশেফ মাহবুব চৌধুরী বলেন, এটি আমার জন্য নয়, আমাদের দেশের জন্য বড় প্রাপ্তি। দেশের জলবায়ু সংকটটা পৃথিবীর কাছে তুলে ধরাটা একটা কঠিন কাজ। এর প্রভাবে বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেটি সহজে বহির্বিশ্বের মানুষ সহজে বুঝতে পারে না। তবে এই হাসপাতালটির মধ্য দিয়ে তারা খুব সহজেই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং তার স্বীকৃতিও দিয়েছেন তারা। হাসপাতালটির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বুঝতে পেরেছেন তারা।
স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী বলেন, হাসপাতাল কেমন হতে পারে, জলবায়ুর পরিবর্তন, বৃষ্টির পানি ধারণ করা, খুব তাড়াতাড়ি বৃষ্টির পানি সরিয়ে নেওয়া, পরিবেশবান্ধব খুব ছোট ছোট বিষয় ধরে ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাজটি করা হয়েছে। সে কারণেই আজকের এই পুরস্কার। তবে ভবনটি করার আগে বা নির্মাণের সময় অবশ্য চিন্তা করিনি এটি বিশ্বসেরা খেতাব অর্জন করিয়ে দেবে। ভাবনাতেও ছিল না।
তিনি আরও বলেন, সবারই ধারণা থাকে হাসপাতাল একটি যন্ত্রের মতো। এক দিক দিয়ে রোগী ঢুকবে, তাদের চিকিৎসা হতে থাকবে, বর্জ্য বেরিয়ে যাবে ইত্যাদি। কিন্তু আমরা সেখানে আটকে থাকিনি, আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আলো বাতাস কীভাবে থাকবে, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ কীভাবে থাকবে, মানসিক দিক থেকেও সুন্দর একটা জায়গা থাকবে সবকিছু চিন্তা করেছি। শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর তর্ক এবং বিতর্কের যে কেন্দ্রস্থল সেখান থেকে আমাদের এই ভাবনার স্বীকৃতি আসাটা একটা বড় ব্যাপার।
প্রসঙ্গত, স্থাপত্য সৌন্দর্যে দৃষ্টি কেড়েছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল শ্যামনগর উপজেলার সোয়ালিয়া ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। মনোরম পরিবেশ, স্বল্প খরচে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয় হাসপাতালটিতে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে হাসপাতালটি। ২০১৪ সালে নির্মাণ কাজ শুরুর পর ২০১৮ সালে শেষ হয়। এরপর থেকেই সেখানে শুরু হয় চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। হাসপাতালটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত। ২০টি ভবনের সমন্বয়ে ৪৭ হাজার ৭৭২ বর্গফুট জায়গাজুড়ে বিস্তৃত স্থাপনা। স্থানীয় প্রযুক্তি ও নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে নির্মিত এই হাসপাতালে আউটডোর ও ইনডোর চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। আরও রয়েছে অডিটোরিয়াম, কনভেনশন সেন্টার, ক্যানটিন ও প্রার্থনা কক্ষ। চিকিৎসক-নার্সসহ ৫৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসিক সুবিধা রয়েছে হাসপাতালটিতে। রয়েছে অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও। সব ধরণের রোগীর চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় এখানে। ৮০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালটিতে সার্জারির ব্যবস্থাও রয়েছে।
আকরামুল ইসলাম/আরএআর