এক গাছে ৩ জাতের বরই, বছরে আয় আড়াই লাখ টাকা
মা-বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন ছেলে। আজ তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু মন মতো চাকরি মেলেনি তার। এতে মন খারাপ হলেও অলস বসে থাকেননি। কৃষি অফিসের পরামর্শ এবং নিজের ভাগ্য বদলের প্রতিজ্ঞা নিয়ে নিজেদের জমিতে শুরু করেন হাইব্রিড জাতের কাশ্মিরি ও বল সুন্দরী বরই চাষ। সেই সঙ্গে সবজি চাষ ও লিচুর বাগান করেন।
বরই চাষে সফলতাও পেয়েছেন। চাকরি না করেও এখন প্রতি বছর আয় করেন আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। অনেক যুবককে প্রশিক্ষণ আর পরামর্শ দিয়ে কুল চাষে আগ্রহী করে তুলছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন জেলার একজন তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা।
বিজ্ঞাপন
বলছিলাম মেহেরপুর গাংনীর জুগিন্দা গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা সাহিবুল ইসলামের কথা। তিনি ওই গ্রামের ফরিদুল ইসলামের ছেলে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এই জাতের বরইয়ের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। খেতেও সুস্বাদু, দেখতেও সুন্দর। বল সুন্দরী বরই দেখতে একেবারে আপেলের মতো। যার কোনো কষ নেই। শিক্ষিত যুবকরা চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষি উদ্যোক্তা হলে জীবন বদলে যাবে।
সরেজমিনে মেহেরপুরের জুগিন্দা গ্রামের সাহিবুলের বরই বাগানে দেখা যায়, এক একটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে বরই। এক গাছে তিন প্রজাতির বরই রয়েছে। কাশ্মিরি, বল সুন্দরী ও দেশি জাতের টক বরই। গাছের পাতার চেয়ে বরইয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ। বরইয়ের ভারে মাটিতে নুইয়ে পড়েছে বাগানের প্রতিটি গাছ। বরই বাগানে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করছেন বেগুন ও সিম। বরই গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাগিয়েছেন লিচু গাছ। কয়েক বছরের মধ্যেই পাওয়া যাবে লিচু। এক জমিতে চাষ হচ্ছে চার ফসল। সাহিবুলের সাফল্য দেখে অনেক শিক্ষিত তরুণরা বরই ও অন্যান্য ফল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
সাহিবুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালে চুয়াডাঙ্গার একটি নার্সারি থেকে ১০০টি চারা গাছ সংগ্রহ করে নিজেদের ৩৩ শতক জমিতে প্রথম রোপণ করি। প্রথম বছরেই সাফল্য পাই। তারপর ২০১৮ সালে ১ একর জমিতে একটি লিচু বাগান করি। লিচু বাগানের সঙ্গে কাশ্মিরি কুল ও আপেল কুল চাষ করে আড়াই লাখ টাকা আয় করি।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি গাছে দুই থেকে তিন বার কুল সংগ্রহ করা যায়। একটি গাছে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি কুল পাওয়া যায়। সেই বাগানের কুল গাছে বলসুন্দরী কলম করেছি। কুল চাষে আমার খরচ হয়েছে ১ লাখ টাকা। এবার কুল বিক্রি করে আমার ৩ লাখ টাকা আয় হবে বলে আশা করছি।
সাহিবুল বলেন, এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর- মাসে যখন গাছে ফুল আসে তখন থেকে পরিচর্যা শুরু করি। এতে তেমন কোনো কীটনাশক বা রাসায়নিক সার লাগে না। তাছাড়া এক খরচে তিন ফসল ফলাতে পারছি।
সাহিবুলের বাবা ফরিদুল ইসলাম বলেন, কাশ্মিরি ও বল সুন্দরী কুল দেখতে সুন্দর এবং মিষ্টি। ঢাকার ব্যাপারীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাগান থেকে বরই নিয়ে যায়। বিক্রির জন্য কোনো ঝামেলা নেই। এক একটি গাছে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি বরই ধরেছে। একবার বিক্রি করেছি। বর্তমানে প্রাতি কেজি বল সুন্দরী কুলের দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। কাশ্মিরি কুলের কেজি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। দেশি টক জাতের কুল বিক্রি হয় ৩০ টাকা।
সাহিবুলের দেখাদেখি এক বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে বলসুন্দরী কুল চাষ করেছেন কৃষক মহসিন আলী। তার বাগানের প্রতিটি গাছ কুলে ভরে গেছে। তিনিও দুই লাখ টাকার কুল বিক্রির আশা করছেন।
কুল চাষে আগ্রহী যুবক আলিউল আজিম বলেন, লেখাপড়া শিখে সাহিবুল ভাই কুল চাষে যে সফলতা পেয়েছেন আমিও তার মতো কুলসহ বিভিন্ন ফলের বাগান করে আর্থিকভাবে সাবলম্বী হতে চাই। এজন্য তার সঙ্গে পরামর্শ নিতে এসেছি। সামনের বছর আমি দুই বিঘা জমিতে কুল ও মাল্টা চাষ করব।
গাংনী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লাভলী খাতুন বলেন, আমাদের সামনে এমন একটি সময় আসছে, যে সময়ে শিক্ষিত ব্যক্তি বা তরুণরা ফল চাষে আগ্রহী হবে এবং তাদের ভাগ্য বদলাবে। ফল বাগান করলে এক জমিতে কয়েক প্রকার ফসল উৎপাদন করা যায়। গাংনীর সাহিবুল তার এক জমিতে তিন জাতের কুল চাষ করেছেন এবং সেই জমিতে বেগুন চাষ করে মোটা টাকা আয় করছেন। সঙ্গে রয়েছে লিচু বাগান। সাহিবুল একজন উদ্যোক্তা। তার দেখাদেখি এলাকার অনেকেই ফল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার খান বলেন, জেলায় চলতি বছরে সাড়ে ৪শ থেকে ৫শ হেক্টর জমিতে কাশ্মিরি, বলসুন্দরী, আপেল ও টক কুলের চাষ হয়েছে। এ কুল একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল। এই ফলে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’। যা শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন। কুল চাষে জেলার তরুণদের বেশি বেশি এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি বিভাগ থেকে কুল চাষসহ বিভিন্ন ফল চাষে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফল চাষ করলে নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধি হবে।
আরএআর