যে বয়সে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ও খেলাধুলা-হইহুল্লোড় বা আনন্দ-ফুর্তিতে থাকার কথা, সে বয়সে কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত সানবীর হোসাইন। নির্ভার শৈশবে যেখানে মেতে উঠবে দুষ্টুমিতে, সেখানে ভার্চুয়াল জগৎকে বেছে নিয়েছে সঙ্গী হিসেবে। ইতোমধ্যে কম্পিউটারের অর্ধশতাধিক প্রোগ্রাম আয়ত্ত করাসহ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসে নিজেকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

পাবনার ঈশ্বরদীর বাঘইল শহীদপাড়ার ১৩ বছর বয়সী এই কিশোরের মাসিক আয় এখন লক্ষাধিক টাকা। করোনায় যখন তার বাবা ব্যাংকঋণে নিয়ে সব হারিয়ে দিশেহারা, ঠিক সে সময় ছোট্ট সানবীর বাবার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সানবীর রাজশাহীর প্যারামাউন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। কবির হোসাইন-সুরভী হোসাইন দম্পতির বড় সন্তান সানবীর। পরিবারে তারা তিন ভাই-বোন। 

আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসা কুড়াচ্ছে সানভীর। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, মালয়েশিয়া, চীন, তুরস্কের মতো দেশের শত শত বায়ার-সেলারের সঙ্গে দক্ষতা দিয়ে বিজনেস কনফারেন্স মিটিং আয়োজন করে যাচ্ছে। ভারতীয় কোম্পানি ড্যাবজন প্রাইভেট লিমিটেড, যুক্তরাষ্ট্রের তোরো ভেঞ্চার এলএসসি, তুরস্কের মেডিকেল কোম্পানি টর্নোস টর্সেনসজসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে ঘরে বসে জব করে সে। পাশাপশি বিমানের ওপরও সে দক্ষতা অর্জন করেছে। মিউজিক চর্চাও করে।

ব্যবসায়ী বাবা ও গৃহিণী মায়ের প্রথম সন্তান সানভীরের ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটার-ইন্টারনেটের প্রতি ব্যাপক আকর্ষণ ছিল। তখন থেকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রতি অন্য রকম ভালো লাগা আজ তাকে বিশ্বের অন্যতম কিশোর উদ্যোক্তা হতে সহযোগিতা করেছে।

চার শতাধিক ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কাজ করছে সানবীর। ‘সানবীর ট্রেডিং’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে সে। এ নামেই ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে পরিচিত সানবীর। করপোরেট, ই-কমার্স, ই-লার্নিং, রিয়েল এস্টেট ও রেন্ট-এ- কারসহ স্ট্র্যাটিক ও ডায়নামিক ওয়েবসাইট ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট করে থাকে।

এইচটিএমল, জাভাস্ক্রিপ্টি, সিএসএস, বুটস্ট্র্যাপ, এসএএসএস, জেকোয়ারি, পিএইচপি, মাইএসকিউএল ডেটাবেইস, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশান, বাগ ফিক্সিং, সাইবার সিকিউরিটিসহ বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষা এবং ফ্রেমওয়ার্কসহ অর্ধশতাধিক কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে সানবীর।

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসে পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাবস, ভ্যান্টিলেটর, ফুয়েল পেট্রোলিয়াম, ইউরিয়া সার, ধাতু, লোহা, পীতলের স্কার্প, ঝুট, ব্যাগ, সানফ্লাওয়ার ওয়েল, রেডিমেড গার্মেন্টস, বিটুমিন (রাস্তার পিচ), এলপি গ্যাস, রিয়েল এস্টেট বিজনেস নিয়ে  ইন্টারন্যাশনাল ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে গড়ে উঠেছে তার সখ্য।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে সানবীর হোসাইন বলে, ছোটবেলা থেকেই আমার মা-বাবার অনুপ্রেরণা আমাকে কম্পিউটারের দিকে ধাবিত করে। শুরুতে মা বকাঝকা করতেন। কিন্তু বাবা আমাকে সাহস দিতেন। তখন থেকেই আমি মূলত মাউস নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম। তারপর থেকে ইউটিউবে টিউটরিয়াল দেখে দেখে কম্পিউটারের যাবতীয় কাজ শিখে আয়ত্ত করে নিই। এখন আমি নিজেই ওয়েবসাইটের জটিল বিষয় সমাধানের টিউটরিয়াল তৈরি করে ইউটিউবে নিয়মিত আপলোড করি।

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসের বিষয়ে সানবীর বলে, ২০২০ সালের মার্চে করোনার শুরু থেকে যখন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে, তখন বাবার ট্রেডিং বিজনেসের হাল ধরি। গুগল সার্চের মাধ্যমে মেইচেউং টেক ট্রেডিং নামে চায়নিজ একটি কোম্পানির সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর কানাডিয়ান প্রফেসর ওমর লায়লানির হাত ধরে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসে পথচলা শুরু হয় আমার। তারপর থেকেই এই বিজনেসের শিক্ষা লাভ করি।

তাদের সঙ্গে বিজনেস করার সূত্রপাত মূলত তখন থেকেই হয়। ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে পিপিই মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাবস, ভ্যান্টিলেটর নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথম থেকেই ব্যাপক সাড়া পাই। এরপর বিক্রি শুরু করি। আন্তর্জাতিক মানের চার শতাধিক মানুষের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ করে থাকি। প্রায় ২০ থেকে ২৫টি বিশ্বের দামি ব্যান্ড আইটেম নিয়ে কাজ করছি এখন।

বড় হয়ে গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানিতে জব করার পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসে ওনারশিপ হয়ে থাকতে চাই। এই বিজনেসকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, এসইও-সহ তথ্যপ্রযুক্তির নানা বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে কাজ শুরু করি, বলে সানবীর।

বাংলাদেশি বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠান গোইনোভিয়ার টেকনোলজির প্রধান নির্বাহী কাহাফিল উরা বলেন, সানবীর শুরুতে আমার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। এরপর নিজেই একজন দক্ষ শিক্ষক হয়ে যায়। সানবীর এতটাই মেধাবী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী যে খুব সহজেই জটিল বিষয়গুলোর সমাধান করতে পারে।

করোনার ছুটিতে মাত্র তিন মাসে সে বিমানের ককপিটের ড্যাশবোর্ডের সুইজিংয়ের বিভিন্ন কাজ রপ্ত করে। ই-কমার্সের যাবতীয় বিষয় সে শিখে ফেলেছে।

মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত তার বিজনেস পার্টনার মাইনুদ্দিন তুষার দ্বীন বলেন, সানবীর খুবই মেধাবী ও দক্ষ কিশোর। বায়ার-সেলারদের সঙ্গে খুব সহজেই যোগাযোগ করে পণ্য বিক্রি করতে পারে। খুব সহজেই তাদের নিয়ে বিজনেস কনফারেন্স মিটিং অ্যারেঞ্জ করতে পারে। আমি অনেক কিছুই জানতাম না। বিজনেস সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলাম। সানবীরের থেকে অনেক কিছু শিখছি।

তুরস্কের ব্যবসায়ী ইঞ্জিনিয়ার গোর্কান সানবীরের বিষয়ে বলেন, এত ছোট বয়সেই সে তার কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতার জায়গায় নিয়ে গিয়েছে বলে আমি মনে করি। সে তার ট্রেডিং বিজনেসের কমিশন লাভ করে। আমাদের গ্রুপের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় সবাই তাকে স্নেহ করে থাকি। তাকে নিয়ে আমরা খুব গর্ব করি।

সানবীরের মা সুরভী হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সানবীর প্রথম যখন মোবাইল-কম্পিউটার নিয়ে দিনরাত পড়ে থাকত, আমি বকাঝকা করতাম। এখন দেখছি ছেলে গতানুগতিক কোনো বাজে আড্ডায় না গিয়ে অনেক বড় ক্যারিয়ার অর্জন করছে। এটা এখন আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সানবীরের বাবা কবির হোসাইন বলেন, ছোটবেলা থেকে ছেলেকে অন্যদের সঙ্গে তেমন মিশতে না দিয়ে কস্পিউটারের দিকে ধাবিত করেছি। ছেলেকে ফেসবুক, ইন্টারনেট ও গ্যামস খেলা থেকে দূরে রাখতে তাকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং বিজনেসের সঙ্গে যোগাযোগে উদ্বুদ্ধ করেছি। অনেক বাবা-মাকে দেখেছি সন্তানদের গেমস খেলার দিকে মনোযোগী করে। এটি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে। 

পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সন্তানদের লেখাপড়া ও খেলাধুলার দিকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের কম্পিউটার-ভিত্তিক অনেক কোডিং (প্রোগ্রাম) শেখার সাইটে যেতে দিন। আমার ছেলেকে নিয়ে এখন আর পেছনে তাকাতে হবে না। সে কম্পিউটারের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করতে পারে। ছেলেকে নিয়ে এখন অনেক বড় স্বপ্ন দেখছি।

ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পিএম ইমরুল কায়েস ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমন প্রতিভাবান কিশোর রাষ্ট্রের জন্য বিরাট সম্পদ। সানবীরকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারলে বিশ্বদরবারে  বাংলাদেশকে সম্মানিত করবে। তার জন্য সরকারিভাবে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এনএ