দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে চা-কমলা, মাল্টা চাষের পর এবার খামার পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে শীতপ্রধান দেশের নজরকাড়া ফুল টিউলিপ। শীতের মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও পরিমিত তাপমাত্রা বিরাজ করায় প্রথমবারের মতো ৮ জন প্রান্তিক কৃষক পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশি জাতের ফুল টিউলিপ চাষ করেই পেয়েছেন সফলতা।

এদিকে উত্তরাঞ্চলে প্রথমবারের মতো টিউলিপ চাষ তেঁতুলিয়ায় হওয়ায় ফুল দেখতে বাগানে পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। বুধবার (২৬ জানুয়ারি) দুপুরে তেঁতুলিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের শারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, কৃষকরা তাদের টিউলিপ ফুল খেতে পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

জানা যায়, নেদারল্যান্ডস, কাশ্মীর, সুইজারল্যান্ডের মতো শীতপ্রধান দেশে এ ফুলের চাষ হয়। যেহেতু পঞ্চগড় শীতপ্রবণ জেলা সেহেতু শীত মৌসুমে এ জেলায় টিউলিপ চাষের সম্ভাবনা থাকায় পরীক্ষামূলকভাবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভলেভমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগিতায় মুক্তা বেগম, আনোয়ারা বেগম, সুমি আক্তার, আয়েশা বেগম, হোসনেয়ারা, মনেয়ারা, মোর্শেদা, সাজেদা বেগম নামের ৮ জনকে চারা দেওয়া হয়।

ফলে প্রথমবারের মতো ৪০ শতক জমিতে ৬ প্রজাতির ৪০ হাজার টিউলিপ ফুলের চারা দিয়ে সহযোগিতা করে তাদের টিউলিপ চাষের স্বপ্ন দেখিয়ে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করে ইএসডিও এবং পিকেএসএফ। পরে কৃষকরা তাদের জমিতে প্রথমবারেই মতো টিউলিপ চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন।

১ জানুয়ারি বীজ (বাল্ব) বপন করেন তারা। বীজ বপনের ২৫ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ফুল ফোটার কথা থাকলেও বীজ বপনের কয়েক দিনের মধ্যেই ফুটেছে ফুল। টিউলিপের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য দেখে অভিভূত কৃষকরা। কৃষকদের খেতে শোভা পাচ্ছে লাল, সাদা, হলুদ, কমলাসহ বিভিন্ন রঙের টিউলিপ ফুল। আর এই ফুল চাষ দেখে স্থানীয় কৃষকরা যেমন টিউলিপ ফুল চাষে আগ্রহী হচ্ছে, তেমনি দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকদেরও নজর কাড়ছে।

মানুষ টিকিট কেটে বাগানে প্রবেশ করছেন, ছবি তুলছেন এমনকি অনেকে ফুল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে দিন দিন পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে টিউলিপ ফুলের বাগানগুলোতে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারলে যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে তেমনি এই অঞ্চলের পর্যটনে নতুন মাত্রা তৈরি করবে।

উদ্যােক্তারা জানান, পিকেএসএফের সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অগার্নাইজেশন দেশের উত্তরাঞ্চলে টিউলিপ ফুল চাষ সম্প্রসারণের উপযোগিতা নির্ণয় শীর্ষক ভ্যালুচেইন পাইলটিং প্রকল্পের উদ্যোগে উপজেলার ৮ প্রান্তিক চাষির মাধ্যমে ৪০ শতক জমিতে লেদারল্যান্ডস থেকে আনা ৪০ হাজার বাল্ব রোপণ করা হয়েছে। এখানে ৬টি প্রজাতির ১২ কালারের টিউলিপ চাষ করা হয়েছে।

এরমধ্যে ডাচ সানরাইস (ইয়েলো), পারপেল প্রিন্স (পারপেল), টাইমলেস (রেড হোয়াইট শেডি), মিল্কসেক (লাইট পিংক), বারসেলোনা (ডার্ক পিংক) নামে রংবেরঙে টিউলিপ ফুলে ভরে উঠেছে বাগান। এছাড়া অ্যাড রেম (অরেঞ্জ), লালিবেলা (রেড), দি ফ্রান্স (রেড), রিপ্লে (অরেঞ্জ), ডেনমার্ক (অরেঞ্জ), স্ট্রং গোল্ডসহ (ইয়েলো) বিভিন্ন প্রজাতির টিউলিপ রয়েছে। প্রতিদিনই বাগানে নতুন নতুন ফুল ফুটছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে সব কলি ফুলে পরিণত হবে। টিউলিপ ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রি এবং রাতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই ফুল চাষ সহনশীল।

এ বিষয়ে কথা হয় তেঁতুলিয়ার সারিয়ালজোত এলাকার টিউলিপ ফুলচাষি মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব। আমাদের জমি আছে সেই জমিতে বিভিন্ন ফসল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতাম। পরে ইএসডিও অফিস থেকে আমাদের টিউলিপ ফুলের বীজ, সার সহযোগিতা করলে ৫ শতক জমিতে এই ফুলের চাষ প্রথমবারের মতো করি। বীজ বপনের কয়েক দিনের মাথায় বাগানে ফুল ফোটা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ বাগানে এসে ফুল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।’

একই কথা বলেন দর্জিপাড়া এলাকার আরেক ফুলচাষি মুক্তা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি টিউলিপ ফুলের চাষ করে সফলতা পেয়েছি। বাগান থেকে প্রতি পিস ফুল ১০০ টাকা দরে বিক্রি করিতেছি। আশা করি বাগানে যে ফুল আছে, তা বিক্রি করে আমি আমার খরচ তুলে বাড়তি অর্থ আয় করতে পারব।’

ইএসডিও’র সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর (এপিসি) ও টিউলিপ প্রকল্পের সমন্বয়কারী আইনুল হক বলেন, ইএসডিও পক্ষ থেকে ৮ জন কৃষকের মাধ্যমে টিউলিপ চাষ করার কয়েক দিনের মধ্যে ফুল ফুটেছে। প্রতিদিন নতুন রঙের ফুল ফুটছে। পর্যটকরাও দেখতে এসে ফুল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। চাষিরা টিউলিপ ফুল চাষ করে এবার লাভবান হবে। বীজ যেহেতু বাইরের দেশ থেকে নিয়ে আসতে হয় যার কারণে খরচ বেশি হয়।

তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রথমবারের মতো তেঁতুলিয়ায় ইএসডিওর সহযোগিতায় ৮ জন কৃষক টিউলিপ চাষ করে সফল হয়েছেন। মূলত তেঁতুলিয়ায় শীত মৌসুমে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করে। তেঁতুলিয়ার তাপমাত্রায় টিউলিপ চাষের সম্ভাবনা থাকায় পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হয়েছে। আমরাও কৃষি অফিস থেকে সব ধরনের সহযোগিতা কৃষকদের দিয়ে যাচ্ছি।

এমএসআর