বিলের অর্থ ছাড়ে দেরি, আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ প্রকল্পের কাজে ধীরগতি
>> বিলের অর্থ ছাড়ে সময় লাগে ৫-৬ মাস
>> অর্থ সংকটে তিন মাস বন্ধ ছিল প্রকল্পের কাজ
>> নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহকারীদের কাছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দেনা প্রায় ১৩ কোটি টাকা
>> তৃতীয় দফায় চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে
বার বার বাড়ছে মেয়াদ। তবুও আশানুরূপ অগ্রগতি নেই আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলওয়ে লিংক প্রকল্পের কাজে। আগামী জুন মাসে শেষ হবে তৃতীয় দফার বর্ধিত মেয়াদ। মহামারি করোনাভাইরাসের থাবার পর এখন অর্থ সংকটে ধুঁকছে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি। অর্থের অভাবে বাধ্য হয়ে তিন মাস কাজ বন্ধ রেখেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মূলত প্রকল্প কাজের বিলের অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে ধীরগতিতে চলছে এ প্রকল্পের কাজ। এর ফলে তৃতীয় দফায় বর্ধিত মেয়াদে কাজ শেষ হওয়া নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাড়ে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আখাউড়া-আগরতলা রেলপথের ৪ কিলোমিটার অংশ ভারতে এবং বাকি সাড়ে ৬ কিলোমিটার অংশ বাংলাদেশে। ২৪০ কোটি ৯০ লাখ ৬৩ হাজার ৫০১ টাকা ব্যয়ে ভারতের নয়াদিল্লির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এ প্রকল্পের কাজ করছে। ব্যয়ের পুরো টাকাই দিচ্ছে ভারত সরকার। এরপর ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই কাজ শুরু করে টেক্সমেকো।
সাড়ে ৬ কিলোমিটার রেলপথে ১৩ থেকে ১৫ হাজার স্লিপার বসানো হবে। চলতি জানুয়ারি মাসেই ১২শ স্লিপার আসবে ভারত থেকে। বাকি স্লিপার আসবে ধাপে ধাপে। এছাড়া পাথর লাগবে ২০ হাজার ঘনমিটার। ইতোমধ্যে সাড়ে ৭ হাজার ঘনমিটার পাথর এসে পৌঁছেছে।
রেলপথটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আগরতলার নিশ্চিন্তপুর সীমান্ত পর্যন্ত যাবে। তবে ১৮ মাস মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ শুরু থেকেই চলছে ধীরগতিতে। ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের প্রেক্ষিতে তিন দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
প্রথমে বর্ষা মৌসুমের কারণে কাজ করতে না পারায় সময় বৃদ্ধির আবেদন করে টেক্সমেকো। এরপর দ্বিতীয় দফায় করোনাভাইরাসের কারণে কাজ বন্ধ রাখায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এবার তৃতীয় দফায় আগামী জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ব্যয় বাড়বে কিনা- সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে কোনো তথ্য দিতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে অর্থ সংক্রান্ত জটিলতা যদি নিরসন না হয়, তাহলে তৃতীয় দফার বর্ধিত মেয়াদেও কাজ শেষ করা যাবে না। এছাড়া দিন যত যাচ্ছে সরবরাহকারীদের কাছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দেনাও বাড়ছে। এখন পর্যন্ত ইট, বালু, রড ও সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহকারীরা প্রায় ১৩ কোটি পাবে বলে জানিয়েছে টেক্সমেকো আখাউড়া অফিস কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহকারী এক ব্যবসায়ী জানান, তিনি আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ প্রকল্পের কাজে ইট, বালু ও মাটি সরবরাহ করেন। টেক্সমেকোর কাছে তার বকেয়া পাওনা হয়েছে ৭০-৮০ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানান, ধাপে ধাপে প্রকল্প কাজের বিল করা হয়। টেক্সমেকোর আখাউড়া অফিস থেকে প্রথমে বিল পাঠানো হয় ভারতের আগরতলায় কনসালট্যান্ট অফিসে। এরপর সেখান থেকে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং হাইকমিশনসহ বেশ কয়েকটি দপ্তর ঘুরে বিলের টাকা পেতে ৫-৬ মাস সময় লাগে। এতে করে অর্থ সংকট দেখা দেওয়ায় ধীরগতিতে চলছে প্রকল্পের কাজ।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্য মতে, বিল বাবদ কয়েক ধাপে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের চুক্তিমূল্যের ৬০ শতাংশ অর্থ পেয়েছে টেক্সমেকো। তবে বিলের অর্থ ছাড়ে সময় বেশি লাগার কারণে এখন পুরো প্রকল্পের কাজে বিলম্ব হচ্ছে। সর্বশেষ গত বছরের জুন মাসে সাড়ে ৪ কোটি টাকার বিল জমা দেওয়া হয়। বিভিন্ন কর্মকর্তার হাত ঘুরে ওই বিলের টাকা গত নভেম্বর মাসে হাতে পায় টেক্সমেকো আখাউড়া অফিস।
তবে বিল জমা থেকে বিলের টাকা পাওয়া পর্যন্ত সময়টাতে চরম অর্থ সংকটে পড়ে টেক্সমেকো আখাউড়া অফিস। এর ফলে বাধ্য হয়ে গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখতে হয়। পরবর্তীতে ওই সাড়ে ৪ কোটির বিলের টাকা হাতে পেয়ে ২৭ নভেম্বর সীমিতভাবে কাজ শুরু করা হয়। তবে পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে এখনও পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলপথ প্রকল্প (বাংলাদেশ অংশ) এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশনের পাশে মাটি রোলিং করা হচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে এখনও মাটি ভরাটের কাজও শেষ হয়নি। এছাড়া রেলপথের ১৬টি কালভার্টের মধ্যে ২ নম্বর কালভার্টের কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। আর ১৪ নম্বর কালভার্টের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ এখনও বাকি। বাকিগুলোর কাজ প্রায় শেষ। তবে ইমিগ্রেশন ভবনের কাজ এখনও অর্ধেকেরও বেশি বাকি রয়েছে।
টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) ও আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলওয়ে লিংক (বাংলাদেশ অংশ) প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ভাস্কর বকশি বলেন, টাকার জন্য তিন মাস কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহকারীদের পাওনার মধ্যে কিছু টাকা দিয়ে কাজ আবার শুরু করা হয়েছে। যেহেতু প্রকল্পের মেয়াদ আর মাত্র ছয় মাস, আর বিলের টাকা পেতেও ৫-৬ মাস সময় লেগে যায়- সেজন্য নতুন করে আর কোনো বিল জমা না দিয়ে নিজস্ব অর্থে প্রকল্পের বাকি কাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলওয়ে লিংক (বাংলাদেশ অংশ) প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, অর্থ ছাড় নিয়ে কোনো জটিলতা নেই। সিস্টেমের কারণে কিছুটা সময় লাগে বিলের টাকা পেতে। এটা শুধু এই প্রকল্পে না, ভারত সরকারের অর্থায়নে যতগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে- সবগুলো একই সিস্টেমে হচ্ছে। এটা দুই দেশের সিদ্ধান্তের বিষয়। এটা নিয়ে আমার বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কিছু করার নেই।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত প্রকল্প কাজের অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। আশা করছি আগামী জুন মাসেই কাজ শেষ হবে। ঠিকাদার যদি চেষ্টা করেন তাহলে কাজ শেষ করতে পারবেন। যদি শেষ না করতে পারেন- তাহলে সেটি ঠিকাদারের গাফিলতি।
আরএআর