গাইবান্ধায় গত এক বছরে ২৪৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ২১৮ জন। জেলা হাসপাতালসহ সাত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্যে এ চিত্র উঠে এসেছে। 

সচেতন নাগরিক ও বিশিষ্টজনরা মনে করেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, পর্নোগ্রাফি, অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহারের ফলে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। অভিভাবকদের অসচেতনতাকেও দায়ী করছেন কেউ কেউ। এছাড়া প্রতিশোধ স্পৃহা, অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এসব ঘটনার জন্ম দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। শুধু আইনের ব্যবহার করেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলছে পুলিশ ও বিশেষজ্ঞরা।

গাইবান্ধা জেলা হাসপাতালসহ সাত উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে সর্বনিম্ন বয়স ৩-১০ বছর বয়সের ১৪ জন, ১১-১৭ বছর বয়সের ১৫৫ জন এবং ১৯ বছরের উর্ধ্বে ৭৬ জন। সব থেকে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১-১৮ বছরের শিশু ও কিশোরী।

নারী, শিশু ও মহিলা বিষয়ক সংগঠনগুলো বলছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফি, নারীর প্রতি অবমূল্যায়নের কারণে সমাজে ধর্ষণ বাড়ছে। সমাজে নারীদের কেবল ভোগ্যসামগ্রী মনে করা হয়। নারীদের নিয়ে অশ্লীল ব্যঙ্গ করা হয়। আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ার কারণেও ধর্ষকের সংখ্যা বাড়ছে। অপরাধীদের সঠিক বিচার নিশ্চিত করা হলে সমাজ থেকে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তারা।

শিক্ষা ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, ব্যক্তি মানসিকতার বিকৃতি, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, বিকৃত পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা এবং আইনের শাসনের সঠিকভাবে প্রয়োগ না হওয়ায় সমাজে অপরাধ বাড়ছে। তবে এক্ষেত্রে অভিভাবকদের অসচেতনতাও দায়ী। এছাড়া সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে ফাঁসিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও সমাজে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। শুধু তাই নয়, প্রতিশোধ স্পৃহা থেকেও কারও কারও বিরুদ্ধে ধর্ষণের মতো মিথ্যে অভিযোগ তোলা হয়। 

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস (ওসিসি) এর গাইবান্ধার প্রোগ্রাম অফিসার রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের প্রেমের সম্পর্কের জেরেই বেশির ভাগ ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া প্রতিশোধ, ক্ষোভের বশবর্তী অথবা কাউকে ফাঁসাতেও অনেক সময় ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। নির্যাতিতদের দ্রুত চিকিৎসা, আইনি সেবাসহ সব ধরনের সহযোগিতা পেতে দফতরগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে থাকে ওসিসি।

জেলা নারীমুক্তি কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নীলুফার ইয়াসমিন শিল্পী বলেন, অপরাধীদের সঠিক বিচার ও কঠিন শাস্তি না হওয়ার কারণেই সামজিক অপরাধ বাড়ছে। অপরাধ করার পরও অপরাধীদের যখন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না তখন অন্যরাও অপরাধ করার সাহস পায়। ফলে দিন দিন ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

গাইবান্ধা জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, শুধু আইন করে সমাজ থেকে ধর্ষণ নির্মূল কিংবা কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। একদিকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকতে হবে অন্যদিকে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তবেই ধর্ষণের ঘটনা রোধ করা সম্ভব।

জেলা পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধর্ষণ নির্মূল কিংবা কমিয়ে আনতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। পুলিশের পক্ষ থেকে নানাভাবে সচেতনতা বিষয়ক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মহামারির কারণে আমরা সবাই আবদ্ধ অবস্থায় আছি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা। এর ফলে কিশোর-কিশোরীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করছে। এতে করে তারা বেশির ভাগ সময়ই জেনে-না জেনে, বুঝে-না বুঝে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। সমাজ থেকে ধর্ষণ নির্মূল কিংবা কমিয়ে আনতে পুলিশের পাশাপাশি সচেতন মহল, অবিভাবক ও শিক্ষকদের সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

রিপন আকন্দ/এসপি