নির্বাচন-পরবর্তী হামলা : গ্রেফতার আতঙ্কে পুরুষশূন্য গ্রাম
চাঁপাইনবাবগঞ্জে নির্বাচন-পরবর্তী ঝামেলায় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার পর গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছে গ্রামবাসী। বৃদ্ধ, নারী ও শিশু বাদে ঘর ছেড়েছেন পুরুষরা। এমনকি ঘটনার পরদিন সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের হোসেনডাঙ্গা গ্রামের মোড়ের সব দোকানপাট বন্ধ ছিল। মোড়-সংলগ্ন এলাকার বাড়িগুলোতে ঘটনার পর বৃহস্পতিবার (০৬ জানুয়ারি) বিকেল থেকেই নেই পুরুষ সদস্যরা।
গ্রেফতার এড়াতে গ্রাম থেকে দূরে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন পুরুষ সদস্যরা। জরুরি দরকার না হলে বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না নারী সদস্যরাও। শুক্রবার (০৭ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় হোসেনডাঙ্গা গ্রামের মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। লোকজনেরও উপস্থিতি তেমন নেই। বাইরে থেকে মানুষ আসা দেখে রাস্তায় বেরিয়ে আসে কয়েকজন বৃদ্ধ ও নারী।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় নারী ও বৃদ্ধরা বলছেন, পুলিশের ওপর হামলার পর থেকেই পুলিশ গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করছে। এ সময় তারা কয়েকজন নিরপরাধ মানুষকেও আটক করেছে। এ থেকেই আতঙ্ক বেড়েছে সবার মনে। তাই গ্রেফতার এড়াতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন গ্রামের পুরুষরা। তবে হোসেনডাঙ্গা মোড়ের এমন অবস্থা হলেও কিছুটা ভিন্ন চিত্র একই গ্রামের শেষ মাথায়।
হোসেনডাঙ্গা মোড়ের কয়েক শ মিটার দূরে গোরস্থান-রেলগেট মোড়ের আশপাশে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। সেখানকার লোকজন বলছেন, ঘটনা যেহেতু ওই পাড়ার, তাই যা হচ্ছে ওই পাড়ার লোকজনকে নিয়েই হচ্ছে ও হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারপরও এখানকার লোকজন পরিস্থিতি বিবেচনায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের হামলার সময় প্রাণ বাঁচাতে পুলিশ সদস্যরা আশ্রয় নিয়েছিল ষাটোর্ধ্ব এমরান আলীর বাড়িতে। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, তারা (হামলাকারীরা) পুলিশের ওপর ব্যাপক মারধর করেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেই আমাদের বাড়িতে।
তিনি আরও বলেন, যারা পুলিশকে মেরেছেন, তারা কোথায় আছে জানি না। কিন্তু এখন আমরা এর ভুক্তভোগী। ভালো-মন্দ যাচাই-বাছাই না করেই পুলিশ গ্রেফতার করছে। তাই এলাকায় কেউ থাকছে না। আমাদের মতো শুধু বয়স্ক কয়েকজন লোক এলাকায় আছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পুলিশ প্রথম বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। নিচ থেকে হামলাকারীরা ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকলে পাশের বাড়ির ছাদ দিয়ে বাড়ির ভেতরে আশ্রয় নেয় ৪ জন পুলিশ সদস্য। আশ্রয় নেওয়া বাড়ির মালিক রবিউল ইসলামের স্ত্রী নিলুফা আক্তার পিংকি বলেন, হঠাৎ দেখি ছাদ দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে রক্তাক্ত ৪ পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে একজনের কপাল থেকে প্রচুর রক্ত পড়ছিল।
তিনি আরও জানান, এক পুলিশ সদস্যদের পোশাক ছিঁড়ে গেছিল। পরে আমি একটি গামছা দেই। পুলিশ সদস্যদের ঘরের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলাম। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলে ঘর থেকে বের করি। গৃহবধূ নিলুফার বাড়ির ছাদে প্রচুর ইটপাটকেল ও ঘরে রক্তের চিহ্ন পাওয়া যায়।
হোসেনডাঙ্গা মোড়ের বাসিন্দা ইসমাইল আলী (৬২) জানান, দুই ছেলের একজন ট্রলি ড্রাইভার আরেকজন অটোরাইস মিলে কাজ করে। দুই ছেলেই কালকের ঘটনার পর বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কারণ পুলিশ গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মোড়ের কোনো দোকানপাটও খুলেনি। পাশের গ্রাম থেকে চা খেয়ে আসলাম। ভয়ে সবাই আতঙ্কিত হয়ে আছে।
মোনাজাত আলীর স্ত্রী সাহনাজ খাতন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে আমার স্বামী নেই। আর কতদিন এভাবে পালিয়ে থাকবে, আল্লাহই ভালো জানেন। এসব ভোট বা ঝামেলার মধ্যে আমরা নাই। কিন্তু পুলিশ ঘটনার পর যাকে তাকে ধরছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভয়ের মধ্যে দিন পার করছি।
শুক্রবার (০৭ জানুয়ারি) দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে ৩৮৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোজাফফর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, সদর থানার এসআই ওসমান আলী বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। মামলায় ১৩৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় শুক্রবার রাত পর্যন্ত ১৫ জনকে আটক করা হয়েছে। আটকদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।
৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে জেলার সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন শরিয়ত আলী। তার কাছে পরাজিত হন বর্তমান ইউপি সদস্য মনিরুল ইসলাম মনি, আব্দুল কুদ্দুস সেরাতাল, আনারুল ইসলাম, আবু বাক্কার ও সাদিকুল ইসলাম। কিন্তু পরাজয় মেনে নিতে না পেরে পরাজিত প্রার্থী মনিরুল ইসলাম মনি ও আব্দুল কুদ্দুস সেরাতাল এক হয়ে তাদের শতাধিক সমর্থকসহ লাঠিসোঁটা নিয়ে নির্বাচনের পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে শরিয়ত আলীর বাড়িতে হামলা চালাতে যায়।
এ খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত শরিয়ত আলীর বাড়িতে হামলার আগেই হোসেনডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে তারা ইটপাটকেল ও লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পুলিশের ওপর হামলায় মোট ৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় তিনজনকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মামলার বাদী হামলায় গুরুতর আহত সদর মডেল থানার এসআই ওসমান আলী।
জাহাঙ্গীর আলম/এমএসআর