নববধূ রেখে রণাঙ্গনে যান মোশারেফ
‘আমি বিয়ে করেছি একাত্তরের ১১ ফেব্রুয়ারি। তখন আমার বয়স ২৭ বছর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত ছিলাম। ছুটিতে ১৯৭০ সালের নভেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসি। পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরির কারণে আমি পাকিস্তানিদের শাসন ও শোষণ দেখেছি। আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা কখনো কিছু বলতে পারতাম না।’
‘তখন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা ছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল বাঙালি। তিনি ৭ মার্চ ভাষণ দিয়ে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ডাক দিয়েছেন। সে ডাক ছিল গোলামি থেকে মুক্তির ডাক। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে বাড়িতে কাউকে না বলে ৪৫ দিনের নববধূ রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।’
বিজ্ঞাপন
এভাবেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের কাছে স্মৃতিচারণ করেন ২ নম্বর সেক্টরের নোয়াখালীর সি-জোনের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোশারেফ হোসেন। তিনি নোয়াখালীর সদর উপজেলার সুজাপুর গ্রামের মৃত আহম্মদ উল্লাহ মিয়ার ছেলে।
রণাঙ্গনে যাওয়ার অনুপ্রেরণা
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোশারেফ হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে আমি অনুপ্রেরণা পেয়েছি। পূর্ব পাকিস্তানিরা কতটা বঞ্চিত ছিল সেনাবাহিনীতে চাকরির ফলে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে শতকরা ৭ জন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারতো অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের শতকরা ৫০ জনের অধিক সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারতো। সেনাবাহিনীর ২৪টা ডিভিশন ছিল তার মধ্যে ২৩টা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের সুরক্ষার জন্য আর একটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য। আমি তাদের শাসন-শোষণ দেখেছি; তাই ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি।
যুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতি
২৫ মার্চ সারাদেশে পাকিস্তানিরা নির্মম হামলা চালায়। এটার খবর পেয়ে ২৬ মার্চ ভোরে একটা শার্ট ও একটা প্যান্ট পরে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে নোয়াখালীর মাইজদীতে চলে আসি। মাইজদীর টাউনহলে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির কার্যালয় ছিল। তখনও সকাল ৮টা বাজে নাই। সেখানে নোয়াখালী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট খায়ের আহম্মদ ছিলেন। আমি তখন বলেছি, ফেনীতে যুদ্ধ চলে আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে এসেছি। কিন্তু আমার কাছে কোনো অস্ত্র নাই।
তখন শহীদ উদ্দিন ইস্কান্দার কচি ভাই, অ্যাডভোকেট আবদুল মালেক উকিল সাহেব, অ্যাডভোকেট আবদুর রব, হানিফ প্রফেসর, নুরুল হক মিয়া, বিসমিল্লাহ মিয়াসহ আওয়ামী লীগের নেতারা জড়ো হলেন। তারা টাউনহলের ভেতরে সভা করে বের হয়ে আমিসহ ১২ জনকে নিয়ে সুধারাম থানায় নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে ওসির সাথে কথা বলে আমাদেরকে ১২টা থ্রি রাইফেল দিলেন।
ফেনীতে যাওয়ার জন্য একটা ট্রাক ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানে একটা চিরকুট লিখে দিলেন আর বললেন ফেনী গিয়ে এমপি খাজা সাহাবের নিকট চিরকুটটা দেখাতে। চিরকুটটা দেখানোর পর তিনি আমাদের ১২ জনকে খাবার দিয়ে একটা স্থান দেখিয়ে দিলেন থাকার জন্য। এরপর ২৮ মার্চ নোয়াখালীর পিটিআইতে এসে দেখলাম মানুষজন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আমি আমার গ্রামের সুজাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি।
লোমহর্ষক স্মৃতিচারণ
সেদিন ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর। মাইজদীতে পাকিস্তান আর্মিরা চলে এসেছে। আমরা ৬টা ট্রুপস তখন রাজগঞ্জে অবস্থান করছিলাম। সেখানে ল্যান্ডফোন থেকে আমি পাকিস্তান আর্মিদের সঙ্গে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছি। তখন আর্মি কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করে বলেছি, আমরা মুক্তিবাহিনী রাজগঞ্জে আছি, তোমরা আসো। পাকিস্তান আর্মি না আসায় আমরা ৪ টা ট্রুপস অন্যত্র যুদ্ধের জন্য নিয়ে যাই। ট্রুপস তুলে নেওয়ার পর তারা ৫ দিক থেকে আক্রমণ করে।
আমরা গোপনে তাদের বুঝিয়েছি রাজগঞ্জে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তাই তারা নোয়াখালী কলেজের মাঠ থেকে মর্টার শেলের মাধ্যমে আক্রমণ করে। ভোর রাত ৪টার দিকে তারা রাজগঞ্জ বাজারের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। তখন সকাল সাড়ে ৮টা বাজে। হাবিলদার হাশেম ওই সময় ব্রাশফায়ার করলে পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার বাহিনীসহ অনেকে মারা যান। একটা সময় পাক আর্মিরা বুঝতে পারে আমাদের অস্ত্র-বারুদ কমে গেছে।
তখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসর কর্মকর্তা হাবিলদার হাশেমের দুই সহযোগী লক্ষ্মীপুরের রবিউল ও সবুজকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হাবিলদার হাশেম তারপর ধানখেতে ছোটাছুটি করছিলেন এমন দৃশ্য গ্রামের সবাই দেখেছিল।
একটা সময় পাকিস্তান আর্মিরা তাকে ধরে ফেলে ও সঙ্গে সঙ্গে মেজরের সামনে গুলি করে মেরে ফেলে। আমরা তাদের কয়েকজনসহ ১৭ রাজাকারকে হত্যা করি। আমরা ব্যাক করার জন্য গুলি করলে পাকিস্তান আর্মি সেখান থেকে পালিয়ে মাইজদী ক্যাম্পে চলে আসে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মোট ৫টি যুদ্ধকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তালিকা করেছে, তার মধ্যে রাজগঞ্জের যুদ্ধ হলো একটি।
সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ
রাজগঞ্জ, বসুরহাট, চন্দ্রগঞ্জ, উদয়সাধুরহাট, খলিফারহাট নামক স্থানসহ সি-জোনে মোট ১৩টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের সবগুলো যুদ্ধই সফল হয়েছে। তখন নোয়াখালীতে রাজাকার বেশি ছিল। পাক বাহিনীর থেকে রাজাকাররা আমাদেরকে বেশি ঝামেলা করতো। আমরা সর্বশেষ ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করেছি। তার আগের দিন ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান আর্মি নোয়াখালী ছেড়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়।
বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। আজ নোয়াখালীতে ১০ তলা দালান দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো রাস্তাঘাট ছিল না। শেখ হাসিনার সরকার দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। এত সুন্দর বাংলাদেশ দেখবো তা স্বপ্নেও ভাবী নাই। বড় বড় প্রকল্প হয়েছে যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা
মুক্তিযুদ্ধ ও নিজের স্বপ্ন নিয়ে মোশারেফ হোসেন বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যে ছিল পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্তি। পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি এনে একটা সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছি। এ কারণে নিজের স্বার্থকে আত্মাহুতি দিয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।
আমাদের দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অল্প কিছু মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাইনি। এখন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে যা হচ্ছে, সবই ব্যবসা। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কিছু সংগঠন রয়েছে যারা নিজেরাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। এসবে আমাকে খুব ব্যথিত করে।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসক খোরশেদ আলম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে নোয়াখালীর অগণিত মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী সব বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন। এছাড়াও আমি তাদের বিভিন্ন সময় খোঁজখবর নেই।
এমএসআর