‘রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে’ ভয়ংকর অপরাধী হয়ে উঠেন আশিক
কক্সবাজারে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে পর্যটককে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ ঘটনায় যার নাম বারবার উঠে আসছে তিনি হলেন আশিকুল ইসলাম। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সরাসরি ধর্ষণে অংশ নিয়েছেন তিনি। এমনকি বন্ধু ও সহযোগীকে নিয়ে দ্বিতীয় ধাপে নারী পর্যটককে ধর্ষণ করেন তিনি।
এদিকে আশিকের ছবি শনাক্ত হওয়ার পর থেকে তার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে আসছে। আশিক থেকে আশিকুল ইসলাম হয়ে উঠার পেছনে কাজ করেছে মূলত কক্সবাজারের রাজনৈতিক শক্তি। ‘রাজনৈতিক প্রশ্রয়েই’ চোর থেকে ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে উঠেন আশিক। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞাপন
আশিক প্রশাসনের হাতে আটক হলে প্রভাবশালী মহলের মুখোশ উন্মোচিত হবে বলে দাবি সচেতন মহলের। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অনেক অসাধু রাজনৈতিক নেতার কুকীর্তিও সামনে চলে আসবে।
স্থানীয়রা বলছেন, নারী পর্যটককে তার সহযোগীরা ধর্ষণ করেছে এটি যেমন সত্য, ঠিক তেমনি সত্য হচ্ছে আশিক ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে উঠার পেছনে ‘রাজনীতিবিদ’রাই দায়ী।
তবে তারা বলছেন, কক্সবাজারে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের মূল হোতা আশিক। তার নেতৃত্বে রয়েছে অন্তত তিন ডজন অপরাধীর একটি চক্র। এই চক্রের মূল শক্তি কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, জেলায় নিজের আধিপত্য নিশ্চিত করতে নেতা হওয়ার পর সাদ্দাম একটি গ্রুপকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করে। তারাই ধর্ষণের অন্যতম হোতা। ২১ ডিসেম্বর রাতেও সাদ্দামের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডায় মেতে ছিল ধর্ষকদের দল। বাহারছড়া ল্যাবরেটরি স্কুলের পাশের আড্ডায় আশিক, জয়, রেশাদ, মোবারক সবাই ছিল। পরে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম সেন্টমার্টিন চলে যান। আর ন্যাক্কারজনক এই ঘটনা ঘটে ২২ ডিসেম্বর রাতে।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, আশিক, জয়, বিজয়, রেশাদ, রানাদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে। পর্যটন এলাকা কলাতলীতে ইয়াবা ব্যবসা, ছিনতাই, অপহরণসহ সব ধরনের অপকর্ম তারাই করে। আর এদের ক্ষমতার উৎস জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম।
অন্য অপরাধীর মতো আশিকের উত্থানটাও ছিল বেশ চমকের। আশিকের এক সময়ের সহপাঠীরা জানান, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয় পেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠে আশিক।
আশিকের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর স্থানীয় আশিক, জয়, রেশাদের সঙ্গে আশিকের সখ্য গড়ে উঠে। আব্দুর রহমান ও আশিক একসঙ্গে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। তখন বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন জায়গায় ও সৈকতের আশপাশের এলাকায় পর্যটকদের কাছ থেকে মুঠোফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়া, চাঁদাবাজি ও মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেওয়া ছিল তাদের নিয়মিত কাজ।
তাদের আশ্রয়ে ছিঁচকে চোর থেকে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হয়ে উঠে আশিক। মাদক, নারী, অবৈধ টাকা এসবের সঙ্গে ছিল তার নিত্য আনাগোনা। নিজের বাংলোয় (বিশেষ কক্ষ) ডেকে নিয়ে বহু তরুণীর সর্বনাশ করেছেন আশিক। নারীর পাশাপাশি মাদক নেশায়ও বুঁদ হয়ে পড়েছিল আশিক।
সন্ত্রাসের পাশাপাশি ইয়াবা ও ছিনতাইয়ে ছিল তার বড় হাত। এসব অপরাধের মধ্যদিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে এলাকার প্রভাবশালীদের নজরে চলে আসে আশিক। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে এলাকার রাজনৈতিক মহলের।
২০১৭ সালের শেষ দিকে ছিনতাইয়ের সময় বিপুল অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় আশিক। ওই একই রাতে পুলিশ অভিযান চালায় তার সহোযোগী জয়ের বাসায়। পুলিশ দেখে পালিয়ে যায় জয়।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশিক প্রথমে ছিঁচকে চোর ছিল। একপর্যায়ে পর্যটক ছিনতাই করতেন। তবে নিষিদ্ধ মাদকের জগতে ঢুকে তিনি ক্ষমতাবান হয়ে উঠেন। বছরখানেক ধরে জেলার প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে আশিকের চলাচল শুরু হয়। কয়েক মাস থেকে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
কক্সবাজার শহরে সাধারণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশিকের ক্ষমতার উৎস শহরের কারও কাছেই অজানা নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে আশিককে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে দেখা গেছে।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সারওয়ার কমলের সঙ্গে ধর্ষক গ্রুপের সদস্য আশিক ও জয়ের সখ্যতা রয়েছে। শহরের যেকোনো অনুষ্ঠানে এমপি কমলের সঙ্গে জয় ও আশিককে দেখা যেত।
ধর্ষক গ্রুপের সদস্য আশিক ও জয়ের সঙ্গে একাধিক ছবিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ মিললেও সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ধর্ষক গ্রুপের কোনো ছেলের সঙ্গে আমার জানাশোনা নেই।’ তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার সঙ্গে ওদের কয়টা ছবি দেখেছেন? সেগুলো একই পোশাকে নাকি ভিন্ন ভিন্ন পোশাকে? আমার মোবাইলে এখন চার্জ নেই। তাই ফেসবুক দেখতে পারছি না।
কমল বলেন, ‘ছবিগুলো বিভিন্ন প্রোগ্রামে হয়তো তুলেছে। আমার সঙ্গে আপনি ছবি তুলে চাইলে কি আমি নিষেধ করতে পারব? এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি আমি। তানাহলে পর্যটকদের অভাবে এই নগরী মরে যাবে।
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম সাদ্দাম হোসেন জানান, ছবি থাকা মানেই ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করে না। আমাদের সঙ্গে অনেকেই ছবি তুলতে চায়। আমরা নিষেধ করি কীভাবে? তার দাবি, আশিক, জয়, মোবারক, রেশাদ, বিজয় কাউকেই তিনি চেনেন না। ওরা ছাত্রলীগের কোনো পর্যায়ের নেতাও নয়।
এর আগে কক্সবাজারে নারী পর্যটককে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ ঘটনায় বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) রাত ৮টার দিকে সদর মডেল থানায় সাতজনকে আসামি করে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী নারীর স্বামী। এর মধ্যে চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে এবং বাকি তিনজন অজ্ঞাত বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মনিরুল গিয়াস।
শনাক্ত হওয়া আসামিরা হলেন- আশিকুল ইসলাম, আব্দুল জব্বার জয়, বাবু ও রিয়াজ উদ্দিন ছোটন। এদের মধ্যে রিয়াজ উদ্দিন ছোটন জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ব্যবস্থাপক। তাকে আটক করেছে র্যাব।
এসপি