বারান্দাভর্তি ডায়রিয়া রোগী, প্রতিদিন আসছে ৫০-৬০ শিশু
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত কয়েকদিন ধরে শিশুদের ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। রোটা ভাইরাসের প্রভাবে শীতের হিমেল হাওয়ায় ডায়রিয়া বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বেডের তুলনায় ৫-৭ গুণ বেশি রোগী, ফলে জায়গা দেওয়া হয়েছে হাসপাতালের বারান্দায়। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে শীতকালীন রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন অন্তত ৫০-৬০ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
শীতের সময়ে মেঝেতে করুণ অবস্থা রোগী ও স্বজনদের। শীতের তীব্রতা ও ঠান্ডা বাতাস থেকে রক্ষা পেতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে বারান্দার চারদিকে কাপড় দিয়ে ঘিরেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুর স্বজনরা ওষুধ না পাওয়ার অভিযোগ করছেন। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। এদিকে অভিভাবকদের বাড়তি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
বিজ্ঞাপন
সদর উপজেলার মহারাজপুর গ্রামের তাসলিমা বেগম আড়াই বছরের নাতনি তাইয়েবাকে নিয়ে দুইদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ওয়ার্ডের ভেতরে তো দূরের কথা বারান্দাতেই জায়গা পাওয়া যায় না। পাটি বিছিয়ে গত সোমবার (২০ ডিসেম্বর) থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি। বাইরে থেকে সবকিছু কিনতে হচ্ছে। ওষুধ, এমনকি খাবার স্যালাইনও কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে।
সদর উপজেলার দেবিনগর গ্রামের হাফেজ আবুল কালাম জানান, ভাগনে জুবাইয়কে (২) ভর্তির ১৪ ঘন্টা হয়ে গেলেও একবারই ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। প্রচুর পরিমাণে ঠান্ডা লাগছে। বাইরে থেকে ঠান্ডা বাতাস আসছে। রাতে মেঝেতে থাকা খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের চরপাঁকা গ্রাম থেকে ছেলের চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাহেরা বেগম। তিনি বলেন, এভাবে মেঝেতে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নেওয়া খুব কষ্টের। সকাল থেকেই অনেক নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে। অবস্থা এমন যে, এখন কেউ আসলে বারান্দাতেও আর জায়গা নেই। তারপরও গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। কি আর করা, সবাই তো বিপদে পড়েই এখানে এসেছে।
ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ইনচার্জ রেহেনা পারভিন ও সিনিয়র স্টাফ নার্স নাসরিন খাতুন ঢাকা পোস্টকে জানান, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শিশুদের জন্য বেড নেই। অথচ দু-একটা ছাড়া সব রোগীই শিশু। হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে সোফা ও বেড মিলে ২৪ জনকে দেওয়া সম্ভব। তবে রোগীর সংখ্যা এর কয়েকগুন বেশি। তাই মেঝেতেই সিংহভাগ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
তারা আরও জানান, বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালে মোট ৫১ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি রয়েছে। সকাল থেকে নতুন করে ২৭ জন ভর্তি হয়েছে এবং গত ২৪ ঘন্টায় ৫০ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে। গত ১০-১৫ দিন থেকে প্রতিদিন রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে।
হাসপাতাল থেকে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে মাত্র ১২ জনের জন্য শুধুমাত্র সকালে ডায়রিয়ার অন্যতম পথ্য ডাব ও চিড়া দেওয়া হয়। বাকি সবাইকে বাইরে থেকে নিতে হচ্ছে। ডায়রিয়া রোগী বাড়তে থাকায় প্রভাব পড়ছে হাসপাতালের সামনে ডাবের দামে। ডাবের দাম বেড়েছে ১০-১৫ টাকা করে। গত ১৫ বছর ধরে হাসপাতালের সামনে ডাব বিক্রি করেন জুলেখা বেগম। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে যেটা ৩০-৪০ টাকা ছিল, তা এখন বেড়ে ৫০-৫৫ টাকা হয়েছে। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই বিক্রিও করছি বেশি দামে। ডায়রিয়ার রোগী বাড়ায় ডাবের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু) ডা. মাহফুজ রায়হান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শীতকালীন রোটা ভাইরাসের কারণে শিশুদের ডায়রিয়া হচ্ছে। প্রায় ৮-১০ দিন ধরে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। প্রত্যেক বছর এ সময়ে এই ভাইরাসের প্রভাব পড়ে। ফলে শিশুরা ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। তবে ঠিকমতো চিকিৎসা নিলে ভয়ের কারণ নেই।
তিনি আরও বলেন, এই সময়ে অভিভাবকদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এবং শিশুদের ঠান্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি শিশু অসুস্থ হলেই তাদের অভিভাবকরা ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে এসে খাওয়ান। অবস্থা গুরুতর হলে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কোনোমতেই এটি করা যাবে না। শুধু মাত্র রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে শিশুদের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. মুমিনুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত কয়েকদিন থেকেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু বেশি ভর্তি হচ্ছে। তাদের চিকিৎসায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। কোনো খাবার স্যালাইন, ওষুধ বা চিকিৎসা ব্যবস্থার ঘাটতি নেই। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে জায়গা না হাওয়ায় বারান্দায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে শীতে রোগী ও তাদের স্বজনদের কথা ভেবে বারান্দার দিকে কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
এমন গাদাগাদি করে চিকিৎসা নেওয়ায় প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস বা ওমিক্রন নিয়ে কোনো ঝুঁকি রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে বর্তমানে কোনো রোগী নেই। এ ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখন পর্যন্ত ওমিক্রনের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। তাই এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই বললেই চলে।
মো. জাহাঙ্গীর আলম/আরআই