গলিত লাশের পোকায় ছেয়ে গিয়েছিল শরীর
‘পাকিস্তানি ট্যাংক যাতে সামনে এগোতে না পারে সেজন্য মাদারীপুরের মোস্তফাপুর এলাকার চােকদার ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে হবে। রাত তখন বাজে ৯টা। সংখ্যায় মাত্র তিনজন আমরা। সুযোগ বুঝে গ্রেনেড নিক্ষেপ করার পরেই দুদিক থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদের ঘিরে ফেলে। আর কোনো উপায় না পেয়ে অন্ধকারে সবাই সেদিন দৌড়ে পালাতে লাগলাম।’
‘কিছুদূর সামনে গিয়ে আমি একটি গর্তের মধ্যে পড়ে গেলাম। সেখানেই চুপ করে বসে রইলাম। ভেবেছি তখন এখন নিরাপদেই রয়েছি। পাশ দিয়ে পাকবাহিনী গুলি করতে করতে চলে গেল। কিছু সময় পর দেখি পা দিয়ে পোকা গায়ে বেয়ে উঠছে। তখন বুঝতে পারলাম আমি সম্প্রতি দাফন করা হয়েছে এমন কবরের ভেতর রয়েছি। সহ্য করতে না পেরে পাশের কুমার নদের ওপর ঝাঁপ দিয়ে ওপারে গিয়ে সেদিনের মতো প্রাণ বাঁচাই।’
বিজ্ঞাপন
একদিন পাকিস্তানি সেনারা ঘটকচর পাহুল্লায় আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। ৩ দিন ধরে চলে যুদ্ধ। এ সময়ে তারা গুলি করে গাছ থেকে নারকেল পেড়ে খেয়েছেন, কুয়াশাভেজা ধানখেতে শুয়েছেন। একের পর এক গোলা বর্ষণে কেঁপে উঠেছিল মাদারীপুর শহর।
সেদিন আমির চৌধুরীর পাশেই যুদ্ধ করছিলেন সরোয়ার হোসেন বাচ্চু শরীফ (বাচ্চু ভূঁইয়া)। পকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে সেদিন শহীদ হন তিনি। এরপরেই তাদের আক্রমণ আরও জোড়ালো হয়ে উঠেছিল। একপর্যায়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে পাকসেনারা। ভারতীয় বাহিনীর কোনো সহযোগিতা ছাড়াই সেদিন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিলেন তারা। তবে এ যুদ্ধে প্রাণ দিতে হয় ৯০ জন বাঙালির। মারা গিয়েছিল ১৭ জন পাকিস্তানি সেনা ও বাকিরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
এটি মৃত্যুকে হাতে নিয়ে একাত্তরের দিনগুলোতে চষে বেড়ানো এক যুবকের যুদ্ধের জীবনকাহিনি। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির চৌধুরী। মাদারীপুরের মানুষের কাছে দুর্ধর্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত।
তারই স্মৃতিতে ফুটে ওঠে বাবার নির্দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক দিনগুলোর কথা বলছিলেন মাদারীপুর জেলার সাবেক ডেপুটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমির চৌধুরী।
যেভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ
বয়স তখনো বিশের কোঠা পার হয়নি আমির চৌধুরীর। টগবটে তারুণ্য, প্রতিবাদী মন। তখন দশম শ্রেণির ছাত্র তিনি। ভাষা আন্দোলন না দেখতে পারলেও তখনকার ভয়াবহ পরিস্থিতি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। স্কুলের বন্ধুরা মিলে দেয়াল দেয়ালে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন স্লোগানের পোস্টার লাগতেন। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে উত্তাল সমগ্র বাংলা।
বাবা আবুল হাশেম ছিলেন মাদারীপুর সদর রাস্তি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। একদিন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। সে ভাষণ শুনে রক্তে আরও আগুন লেগে গিয়েছিল তার। আমির চৌধুরীর বাবা রাস্তি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি থাকায় আবুল হাশেমের মাধ্যমেই ইউনিয়নের যুবকদের যুদ্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশনা আসে।
দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য বাবার নির্দেশে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন আমির চৌধুরী। মায়ের কাছে কিছু না বলেই হাতে একটি থালা, গামছা, চাদর ও হাফ প্যান্ট পরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ১৩ এপ্রিল মাদারীপুরের হাজার হাজার মানুষ সেদিন জড়ো হয়েছিল নাজিমুদ্দিন কলেজ (বর্তমনে মাদারীপুর কলেজ) মাঠে।
সেখান থেকে যুদ্ধ করতে শারীরিকভাবে ফিট এমন ১৬৫ জনকে বাছাই করা হয়। আমির চৌধুরী, খলিলুর রহমান খানা, সরোয়ার হোসেন বাচ্চু শরীফ, মাহবুব আহমেদ মিলন কাজী, জাহাঙ্গীর কবির, কামাল কাজী, হারুন শরিফ, কালাম হোসেন, মোকলেছ হোসেন, আতিয়ার রহমান, আলি কাজীসহ অনেকের নাম প্রথম কাতারেই থাকে।
প্রথমে তারা কয়েকদিন সেখানেই ক্যাপ্টেন শওকত, সৈয়দ সাইদুর রহমান, খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে শারীরিক প্রশিক্ষণ নেন। পরে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন শওকতের নেতৃত্বে ১৭ এপ্রিল ১৬৫ জনের একটি দল ভারতের উদ্দেশে রওনা হন।
মাদারীপুর সদর মহিষের চর এলাকা থেকে লঞ্চে উঠে রওনা হন তারা। লঞ্চ থেকে নামেন ফেনীর নীলকমল এলাকায়। সেখান থেকে হেঁটে আসেন ফেনীর পরশুরাম এলাকায়। পরে স্টুয়ার্ড মুজিব (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামালার তিন নাম্বার আসামি) তাদরে গাইড করে ভারতের উদ্দেশে রওনা করেন।
টানা তিন দিন হেঁটে অনেক কষ্টে তারা বাংলাদেশের বর্ডার পার হয়ে ভারতে চলে আসেন। সেখান থেকে তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়িতে চড়ে ভারতের ত্রিপুরার কাঁঠালিয়া এলাকায় আসেন। ২৮ দিনের ট্রেনিং শেষ করে ২৯ মে বাংলাদেশে আসার জন্য প্রস্তুত হন।
কিন্তু তখন বাংলাদেশে নিরাপদে ফিরে আশা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। দেশজুড়ে চলছে তুমুল যুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি মারা যাচ্ছেন। যেখানে সেখানে পড়ে রয়েছে লাশ। খবর পান মাদারীপুরের অবস্থাও ভালো নয়। পাকিস্তানিরা ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং অকাতরে নিরীহ মানুষ মারছে। পরিবারের কে কোথায় আছেন, কোনো খবর নেই।
যেভাবেই হোক মাদারীপুরে ফিরতে হবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তারা। জীবনবাজি রেখে কয়েকদিন হেঁটে তারা নিজ এলাকায় ফিরতে সক্ষম হন তারা। ফিরে এসে সবাই কয়েকদিন বিচ্ছিন্নভাবে থাকলেও কিছুদিন পরে আবার সবাই একত্র হন। কিন্তু কেউ খলিলুর রহমান খানকে খুঁজে পাচ্ছেন না। সাবাই ভেবে নিয়েছেন তিনি হয়তো পাকিস্তানিদের হাতে মারা গেছেন। পরে তারা তাদের দলের নাম দেন ‘খলিল বাহিনী’। দেড় শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন খলিল বাহিনীতে, তারা মাদারীপুরের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ পরিচলানা করেন।
হঠাৎ একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনেক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে খলিলুর রহমান খান সবার মাঝে এসে হাজির হন। পরে সবাইকে জানান তিনি এতদিন ভারতে ট্রেনিংয়ে ছিলেন। এরপরে খলিল বাহিনীর কমান্ডার খলিলের নেতৃত্বে তারা মাদারীপুরের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। একের পর এক সফল অপারেশনের জন্য খলিল বাহিনীর নাম তখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
তখন আমির চৌধুরী ছিলেন বাহিনীর অন্যতম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাকবাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য তাদের অস্ত্র ছিল খুবই অল্প ও লোক সংখ্যা ছিল অনেক। তাদের ক্যাম্প ছিল মাদারীপুর সদর ঘটকচর পাহুল্লা এলাকায়। খলিল বাহিনীর কমান্ডার খলিলের নেতৃত্বে মাদারীপুরে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশেনগুলো তারাই পরিচালনা করেছেন।
তারা মাদারীপুরের ছিলারচরে পকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করেছেন, মোস্তফাপুর সমাদ্দার এলাকার ব্রিজ ভেঙে দিয়েছেন। মহিষের চর পাকিস্তানি বাহিনীর বাস বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন, চরমুগিয়ারায় পাক বাহিনীর ক্যাম্পে আগুন লাগানোসহ বিভিন্ন যায়গায় তারা অভিযান পরিচালনা করেছেন। সর্বশেষ তারা ঘটকচর পাহুল্লায় ৩ দিন যুদ্ধের মাধ্যমে পকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হন ভারতীয় বাহিনীর কোনো সহযোগিতা ছাড়াই।
কেমন আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির চৌধুরী
আমির চৌধুরীর বয়স এখন ৬৭ বছর। বয়সের ভারে ও শারিরীক নানা সমস্যার কারণে হাঁটাচলা করতে পারছেন না তিনি। দুই স্ত্রী ও চার ছেলে নিয়ে তার সংসার। দুই ছেলে পুলিশের কনস্টেবলের চাকরি করলেও তাদের আলাদা সংসার। একটি ঘরে কোনোমতে জীবনযাপন করছেন আমির চৌধুরী। সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন স্বীকৃতি, মানুষের কাছ থেকেও পেয়েছেন সম্মান। কিন্তু তার অর্থনৈতিক দুরবস্থা এখনো কাটেনি।
আমির চৌধুরীর স্ত্রী সালেহা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা। সরকার স্বামীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এলাকার সবাই তাকে অনেক সম্মান করেন। আমি চাই স্বামীর সম্মান চিরজীবন এমনই থাকুক। তিনি এখন অসুস্থ। সবার কছে দোয়া চাই।
স্থানীয় বাসিন্দা এমদাদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি এলাকার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তিনি এখনো আমাদের এলাকার একজন অভিভাবক। শুধু এই এলাকার নয়; পুরো মাদারীপুরবাসীর একজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে চিনে।
আমির চৌধুরী বলেন, আমারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছি কিন্তু যারা তখন যুদ্ধ করনি তার আজ বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে অনেক সুযোগসুবিধা নেয়। আমার দুই ছেলে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি করলেও তারা এখন আলাদা সংসারে থাকে। আমি যা পাই তাদিয়ে কোনোভাবে চলছি।
প্রতি মাসে অনেক টাকার ওষুধ কিনতে হয়। ঘরের অবস্থাও ভালো নয়। তারপরেও কিছু চাওয়ার নেই। দেশকে স্বাধীন করেছি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য না। মানুষ সম্মান করে ও সরকার আমাদের সম্মান দিয়েছে, এটাই অনেক পাওয়ার।
যুদ্ধকালীন খলিল বাহিনীর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমির চৌধুরী ছিলেন সক্রিয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে তিনি অসুস্থ। আমার সঙ্গে তার প্রায়ই কথা হয়। যারা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি সবার সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে। আমাদের বন্ধুত্ব এখনো অটুট রয়েছে।
মাদারীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান হাওলাদার বলেন, আমির চৌধুরী একজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় খলিল বাহিনীর নেতেৃত্বে তারা অনেক বড় অপারেশন করেছিলেন। আমির একসময় মাদারীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন।
এমএসআর