নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে নির্বাচনী সহিংসতায় বিজিবি সদস্য নিহতের ঘটনায় গ্রেফতার আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে সাতটি গ্রাম। বাড়ি-ঘরে তালা দিয়ে পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন অনেকে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বাড়িতে দিন কাটাচ্ছেন বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা। তবে এর মাঝেও স্কুলে ফিরতে শুরু করেছে পশ্চিম দলিরাম মাঝাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যদিও এই উপস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে ‘হোম ভিজিট’ শুরু করেছেন শিক্ষকরা।

নির্বাচনী সহিংসতায় গেল ২৮ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম দলিরাম মাঝাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রটিতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বিজিবি ল্যান্স নায়েক রুবেল মন্ডল।

এ ঘটনায় ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ললিত চন্দ্র রায়। এরই মধ্যে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ নিয়ে গত ১১ডিসেম্বর অজ্ঞাত ২৪০ জনকে আসামি করে আরও পাঁচটি মামলা হয়েছে।

ঘটনার পর থেকে গ্রেফতারের ভয়ে পশ্চিম দলিরাম, মাঝাপাড়া, বানিয়াপাড়াসহ অন্তত সাতটি গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। সহিংসতার ২৪ দিনেও খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যায়নি এলাকাটিতে। কয়েকটি বাড়িতে কিছু নারী, স্কুলশিক্ষার্থী ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়েনি। যারা বাড়িতে আছেন তাদের চেহারায় আতঙ্কেও ছাপ। তাদের অভিযোগ প্রতি রাতেই চলে পুলিশি অভিযান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঢাকা পোস্টকে জানান, কিছু নারী এলাকায় এলেও সন্ধ্যা নামার আগে তারা অন্যত্র চলে যান। সঙ্গে সন্তানদেরও নিয়ে যান। কেউ হয়তো বাবার বাড়ি, কেউ হয়তো চাচার বাড়ি, কেউ হয়তো বোনের বাড়িতে অবস্থান করছেন। সকাল হলে আসেন আবার সন্ধ্যার আগে কাজ সেরে চলে যান।

মাঝাপাড়া এলাকার গৃহিণী মৌসুমী বেগম বলেন, আয় উপার্জন করে সংসার চালায় পুরুষ মানুষেরা। ওমরায় বাড়ি ছাড়া। অনেক দিন হয়া গেলো ভয়ে বাড়ি আসছে না। পুলিশ বলি ধরি যাইবে এজন্য। যারা অপরাধী তাদের ধরুক, আর যারা দোষ করে নাই, ওইলা মানুষোক যেন না ধরে। ভয়ে আতঙ্কে বাড়ি ছাড়ি পালাইছে মানুষগুলা। অনেক মহিলাও চলি গেইছে। সাথে ছাওয়ালাক নিয়া গেইছে ওই জন্য স্কুলে যাবার পায়ছে না ওমরা।

পশ্চিম দলিরাম মাঝাপাড়া সরকিরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সৌদি আক্তার বলেন, ২৯ নভেম্বর থেকে চার দিন আমরা একাডেমিক ভবনে প্রবেশ করতে পারিনি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে অবস্থান করায় স্কুলের মাঠে আমরা উপস্থিত থেকে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে চলে এসেছি।  ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত তেমন শিক্ষার্থী আসেনি স্কুলে। ১৪ ডিসেম্বর থেকে কিছু শিক্ষার্থী স্কুলে আসা শুরু করে। যা অব্যাহত রয়েছে। মূলত শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসার প্রবণতা দেখা গেছে মামলার প্রধান আসামি মারুফ হোসেন অন্তিক গ্রেফতার হওয়ার পর  থেকে।

বিদ্যালয়টিতে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২১০ জন। এর মধ্যে এখন উপস্থিতির হার অর্ধেকেরও কম। চতুর্থ শ্রেণির ৪০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৫-২০ এবং পঞ্চম শ্রেণির ৩৫ জনের মধ্যে আসছে ১৫-১৭ জন।

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতী আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলে, স্কুলে আগের মতো আনন্দ নেই। বেশির ভাগ বন্ধু-বান্ধব আসছে না। খেলাধুলা হচ্ছে না। সবাই আতঙ্কে রয়েছে। কয়েক দিন থেকে কিছু সহপাঠী আসা শুরু করেছে।

সুমাইয়া আক্তার নামে আরেক শিক্ষার্থী জানায়, এলাকার অনেক শিক্ষার্থী বাড়িতে নেই। বাবা-মায়ের সঙ্গে পলাতক রয়েছে। সে কারণে তারা স্কুলে আসছে না। স্কুলে আসতে চাইলেও ভয়ের কারণে আসছে না অনেকে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গুমোট একটা অবস্থা ছিল। নির্বাচনী সহিংসতার পর থেকে বলা যায় পুরো এলাকা মানুষশূন্য। এখন এলাকায় মানুষজন ফিরতে শুরু করেছে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে শুরু করেছে। তবে সন্তোষজনক নয়। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে আমরা হোম ভিজিট করছি। তাদের স্কুলে আসতে বলছি।

তিনি বলেন, যদি তারা না আসে তাহলে পিছিয়ে পড়বে। করোনায় দীর্ঘ দিন গেল। এখন গুরুত্বপূর্ণ সময়। পড়াশোনা নিয়ে মূল্যায়ন চলছে। সে কারণে তাদের উপস্থিতি দরকার।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচনী সহিংসতার পর কিছু দিন আলামত হিসেবে বিদ্যালয়টি নিজেদের আয়ত্ত্বে রেখেছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। বিদ্যালয় খোলা হচ্ছে এবং শিক্ষকরা নিয়মিত যাচ্ছেন। তবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে ঘাটতি রয়েছে। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে হোম ভিজিট করার জন্য।

কিশোরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল আউয়াল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ পর্যন্ত এই মামলায় ১৭ জন গ্রেফতার হয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন জামিনে আছেন। বাকি আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার করতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।

নীলফামারীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত কাজ চলছে। প্রকৃতপক্ষে সহিংসতায় যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। নিরাপরাধ মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটি দেখা হবে।

উল্লেখ্য, ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী মারুফ হোসেন তার বাড়ির পাশের ভোটকেন্দ্র দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এরই এক পর্যায়ে দুপুর ৩টার দিকে ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। সন্ধ্যার পর ভোট গণনার সময় মারুফ তার দলবল নিয়ে ব্যালট ছিনিয়ে নিতে ভোটকেন্দ্রে হামলা চালায়।

এ সময় সহিংসতায় নিহত হন বিজিবির সদস্য রুবেল হোসেন। এক দিন পর ওই ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামি মারুফকে আশুলিয়া থেকে ১৩ ডিসেম্বর রাতে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

এসপি