টানা ১৯ দিন টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম
‘পরাধীনতার গ্লানি থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে মৃত্যু শ্রেয়’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই বাণী তাকে খুব টানত। শৈশব থেকেই সৈনিক হওয়ার মানসিকতা তার মধ্যে ছিল। ফলে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান থেকে ডাক এলো। এরপর আর নিজেকে ঘরে আটকে রাখতে পারেননি। পাকিস্তানের পরাধীনতার নাগপাশ ভেঙে দেশমাকে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি স্বাধীন পতাকা উপহার দেওয়ার জন্য জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ছেলের দেশপ্রেম দেখে শেষ পর্যন্ত মা মতামত দিলেন যুদ্ধে যাওয়ার। ঘরে রাখা স্টেনগান তুলে দিয়েছিলেন হাতে।
এরপর শহর-গ্রাম ঘুরে যুদ্ধ, যোদ্ধা সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত করেছেন বরিশালে। ধরা পড়ে টানা ১৯ দিন টর্চার সেলে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। শুনলে গল্পের মতোই লাগে। যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তার অনেক পূরণ হয়েছে, বাকি আছে আরও কিছু। তবে এখনও প্রত্যাশা করেন অসাম্প্রদায়িক স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে উঠবে। এই স্বপ্নের মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা এমজি কবির ভুলু। জীবন সায়াহ্নে এসেও এক নাগাড়ে বলে গেলেন যুদ্ধের দিনগুলোর রক্তমাখা স্মৃতিকথা।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধে যাওয়া যেমন দায়িত্ব ছিল তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাও আমার দায়িত্ব। আমি না বলে গেলে ওরা জানবে কীভাবে? ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অপরাধে যে ভবনে দিনের পর দিনে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল মিলিটারি সেই টর্চার সেলের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা :
এমজি কবির ভুলু ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন বরিশালে। বাবা মৃত আবুল কাশেম মুন্সী আর মা ছালেহা খাতুন। সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বোন। এমজি কবির ভুলু ছিলেন ভাইদের মধ্যে বড়। ১৯৭১ সালে সরকারি ব্রজমোহন কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তখন দেশের ১৯টি কলেজে ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর (ইওটিসি) ছিল। ছোটবেলা থেকে সৈনিক হওয়ার ইচ্ছায় কলেজে ভর্তি হয়েই ইওটিসিতে যোগ দেন। সেখানে ট্রেনিং সম্পন্ন করেন।
এমজি কবির ভুলু বলেন, আমি বিএম কলেজের ইওটিসির দায়িত্বে ছিলাম। ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করল তখন বরিশাল শহরের পেশকারের বাড়িতে ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠান চলছিল। সেই অনুষ্ঠানে ছিলাম আমি। অনুষ্ঠান শেষ করে রাত ১১টার দিকে বাসায় ফিরি। রাত ১টার দিকে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডা. লুৎফর রহমান ও ডা. মইনুল ইসলাম আমার বাসায় গিয়ে জানায়, ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তোমার কাছে এলএমজি আছে, অস্ত্র দাও। আমার কাছে অস্ত্র রয়েছে বিষয়টি ওরা জানত। কারণ ইওটিসির প্রশিক্ষণ কোরে একটি পিনকাটা মার্কিন লাইট মেশিনগান (এলএমজি) থাকত। ৩০টি রাইফেল ছিল। এর মধ্যে ২৪-২৫টি স্বয়ংক্রিয়, বাকি ৫-৬টি ছিল কাঠের রাইফেল। এগুলো আমার দায়িত্বে কলেজে থাকত। তাৎক্ষণিক কী করব তা বুঝতে পারছিলাম না। সকালে দেবো বলে ওদের পাঠিয়ে দেই।
সকালে যখন রাস্তায় বের হই তখন বরিশাল জনমানবশূন্য। কলেজে গিয়ে দেখি দারোয়ান-পিয়নও নেই। অস্ত্র বের করব কীভাবে? মুশকিলে পড়ে যাই। বিএম কলেজের স্টেনোকক্ষে এলএমজিটি রাখা ছিল। প্রথমে দরজার তালা ইট আর শাবল দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। ক্যাডেট শহীদের বাসা ছিল কলেজের সামনে। তাকে ডেকে এনে তার কাঁধে ভর করে ভেল্টিলেটর ভেঙে রুমে ঢুকে এলএমজিটি নিয়ে বের হয়ে আসি। সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে বেলস পার্কে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু উদ্যান) গিয়ে ট্রেনিংয়ে যোগ দেই। সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিলের তত্ত্বাবধায়নে বেলস পার্কে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের নেতৃত্বে ট্রেনিং চলছিল। ইওটিসির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিধায় আমি, মান্নান, আলেব, আবু প্রশিক্ষণ করানো শুরু করি।
তিনি বলেন, ঢাকা আক্রান্ত হওয়ার পরও এক মাস বরিশাল মুক্ত ছিল। সেই সুযোগে ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর এমএ জলিলের নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং করিয়ে সম্মুখযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া চলছিল। এর মধ্যে ১৭ এপ্রিল দুইজন গুপ্তচর ধরা পড়ল। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য মিলিটারিদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিল। তাদের ধরে এনে এমএ জলিলের নির্দেশে একজনকে চাঁদমরী এলাকায় ফায়ারিং স্কোয়াডে দেই। ১৮ এপ্রিল আমরা নিয়মিত বেলস পার্কে প্রশিক্ষণে ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পাই ফাইটারের আওয়াজ। বেলস পার্কে আমাদের ট্রেন্স (গর্ত) করা ছিল। ফাইটারের আওয়াজ শুনে ট্রেন্সে আশ্রয় নেওয়ার জন্য ছুটতে গিয়ে দেখি কোনো ট্রেন্স গলা পর্যন্ত পূর্ণ, কোনোটি কোমর পর্যন্ত। সেখানে জায়গা না পেয়ে বেলস পার্কের পাশে দুটি রেইনট্রি গাছের শিকড়ের মাঝে নিজেকে আত্মগোপন করি।
ফাইটার ঠেকাতে অনেকেই ট্রেন্সের ভেতর থেকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে গুলি ছোড়ে। দুজন ফাইটার যখন দুই দিকে ভাগ হয়ে গুলি ছুড়তে গেল তখন দৌড়ে পাশেই জজ সাহেবের বাসায় আশ্রয়ের জন্য যাই। জজ সাহেবের গাড়ির বারান্দা থেকে বাসার বারান্দায় কেবল পা দিয়েছি তখন পাশের একটি ছেলের বুকের বাম পাশে গুলি লাগে। সেখানেই ঢলে পড়ে সে। ফাইটার চলে যাওয়ার পরে আমি সরাসরি বাসায় চলে আসি। কারণ আমার অস্ত্রটি তখন বাসায় রাখা ছিল।
হাতে স্টেনগান তুলে দেন মা :
বাসায় গিয়ে দেখি, পরিবারের সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। মা বললেন, বাবা তুমি ঘরের বড় ছেলে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঘরের বাইরে কোথাও যাবে না। আমি উত্তরে বললাম, মা তুমি আল্লাহকে বিশ্বাস করো? মা জবাব দিলেন, করি। হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। তোমার কোল থেকে টেনে নিয়ে যদি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলে তুমি ঠেকাতে পারবে? মা বললেন, না। তাহলে তুমি আমাকে বাধা দিও না। আমি সিদ্ধান্তে অনড়, যুদ্ধে যাবই। আমার অস্ত্র দাও। মা অনেকক্ষণ থেমে ছিলেন।
তারপর ঘর থেকে স্টেনগানটি এনে আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আল্লাহ তুমি আমার ছেলের প্রাণ পাতার আড়ালে রেখে দিও। ৬৫ জনকে নিয়ে ইছাকাঠি গার্ডেনের দায়িত্ব দেওয়া হলো আমাকে। ওই গার্ডেনে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেই আমি এবং খোকা চৌধুরী। কিছু দিন পরে ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ আসায় তিনি দায়িত্ব নেন। আমরা তার নেতৃত্বে অপারেশন শুরু করি।
সাধারণ নারী হয়ে গেলেন যোদ্ধা :
২৫ এপ্রিল সড়ক, নৌ এবং বিমান পথে বরিশাল আক্রমণ করলো মিলিটারি। তখন আমাদের ৬৫ জনের মধ্য থেকে বাছাই করে ৩৫ জনকে নিয়ে বাহিনী গঠন করলাম। সেখান থেকে কৃষি বিভাগের পিকআপ গাড়িতে করে মাধবপাশা জমিদার বাড়িতে গিয়ে অবস্থান করি। সেখান থেকে স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানায় গিয়ে স্কুলে ঘাঁটি করলাম। সেই রাতে ক্যাপ্টেন বেগ আমাদের নির্দেশ দিলেন থানা অপারেশনের। পুরানপাড়ার আলতাফ, বাউফলের পরিমল, বরগুনার মালেকসহ আমরা আটজন সশস্ত্র যোদ্ধা রাতে থানা আক্রমণ করি। সেখানে মিলিটারি হটিয়ে থানার ১৯টি রাইফেল নিয়ে আসি। ওই অপারেশনের পর বিথী এবং শিশির কনা মল্লিক নামে দুই নারী যোদ্ধা আমাদের দলে যোগ দেয়।
খবর পেলাম নিকটস্থ বাউকাঠিতে মিলিটারিরা তাণ্ডব চালাচ্ছে। সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক আমাদের খবর দেয় যে তারা চাড় (সাঁকো) ফেলে দিয়ে মিলিটারি আটকেছে। খবর পেয়ে আমরা নৌকাযোগে সেখানে যাই। বাউকাঠিতে মিলিটারি তাণ্ডব চালিয়ে যখন লঞ্চে উঠছিল তখন আমরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করি। সেখানে আমাদের সঙ্গে মিলিটারির কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা গোলাগুলি হয়। এরপর তারা লঞ্চ ছেড়ে চলে যায়।
সংগঠিত হলো গ্রামবাসী :
বাউকাঠিতে যুদ্ধে আমরা শিখলাম মিলিটারিদের অস্ত্রের সামনে আমাদের অস্ত্র শক্তিশালী নয়। এজন্য ৩৫ জনের গ্রুপ ভেঙে দিয়ে যদি কেউ স্বেচ্ছায় বাড়ি যেতে চান তাহলে সে বাড়ি চলে যাক। তখন বিথী এবং শিশির কনা মন্ডলকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য বলি। তারা জানায়, কিছুতেই তারা বাড়িতে ফিরবেন না। আমরা যতই বলি, তারা যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড়। তাদের ভাষ্য, বাড়ি গেলে যে প্রাণ বাঁচবে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাহলে যুদ্ধ করে মারা যাওয়াই ভালো।
ক্যাপ্টেন বেগ বললেন, আমি ফিরব না। কাল গানবোট অপারেশন করব। এরপর বেগ ভাই, বিথী, শিশির কনা মন্ডল, পরিমল, মালেকসহ ছয়জন একদিকে আর আমরা আরেক দিকে ভাগ হয়ে গেলাম। আমি স্টেনগান ও রাইফেল নিয়ে হেঁটে আগৈলঝাড়ার উদ্দেশে। কিছুদূর এসে স্টেনগানটি রেখে রাইফেল দুটি নদীতে ফেলে দেই। কারণ স্টেনগান জামার নিচে করে বহন করা যায়। কিন্তু রাইফেল লুকানো যায় না, মিলিটারি বা রাজাকাররা দেখে ফেলবে।
আগৈলঝাড়ায় আমার পুরোনো বাড়িতে মাটি খুঁড়ে কলাগাছ চাপা দিয়ে অস্ত্র লুকিয়ে রাখি। ৫ দিন পরে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে আক্রমণ হলো। পাঁচ দিন পর হেঁটে বাবুগঞ্জের পথে যাত্রা শুরু করি। সেখানে এক দিন পরে খবর পেলাম যোদ্ধা নজরুল ধরা পড়েছে। সেখান থেকে গেলাম কমিশনারের চর। সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রায় এক-দেড়শ লোককে সংঘবদ্ধ করি। এরপর অস্ত্র আনতে আবার রওনা দিলাম আগৈলঝাড়া পুরান বাড়িতে। মেহের মাঝির নৌকায় শেষ রাতে গিয়ে বাড়িতে পৌঁছি। সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হই। টার্গেট ছিল বরিশালে পৌঁছে পাওয়ার হাউস আক্রমণ করব।
টর্চার সেলের দুর্বিষহ ১৯ দিন :
এমজি কবির ভুলু বলেন, শেষ রাতে যখন অস্ত্র নিয়ে নৌকায় রওনা দিলাম তখন ছোটা চাচা মাহিলাড়া দিয়ে আসার জন্য বললেন। কিন্তু মাহিলাড়ার নৌপথে প্রচুর কচুরিপানা থাকায় বাটাজোরের দিকে রওনা দেই। ভোর ৫টার মধ্যে বাটাজোর অতিক্রম করব এই ছিল ইচ্ছা। কিন্তু সেদিন এত বেশি কুয়াশা পড়েছে, বাটাজোরে পৌঁছাতেই সকাল ৮টা বেজে গেছে। বাটাজোরে পৌঁছাতেই মিলিটারি চেকে পড়লাম। আমি আমার সহযোদ্ধা আনোয়ারকে কাপড়ে মোড়ানো অস্ত্রের ওপর শুইয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু যখন নৌকায় তল্লাশি চালানো হয় তখন তারা অস্ত্র পায়। আমরা যে মুক্তিবাহিনী তা তাদের বুঝতে আর বাকি রইল না। আমাদের তীরে তুলে মোটা দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধল। নৌকায় ১৩ জন ছিলাম। সবাইকে এক সারিতে দাঁড় করাল। আমি তখন তওবা পড়লাম। চার কালেমা পড়লাম। বুঝেছি জীবন এখানেই শেষ।
সেখানকার দায়িত্বরত হাবিলদারকে আমি বললাম, হাবিলদারসাব আমার মতো একটি ছেলে মেরে আপনার কোনো লাভ হবে না। অস্ত্রটি রেখে আমাদের ছেড়ে দেন। তিনি আমাদের কোনো কথা শুনলেন না। রাস্তায় ফেলে অবর্ণনীয় পেটানো শুরু করলেন। হাবিলদারের টেবিলের ওপর গ্রেনেড, অস্ত্র রাখা ছিল। আমি আরেকটি টার্গেট নিলাম। হাবিলদারকে বললাম, কিছুক্ষণ পরেই তো আমাদের মেরে ফেলবেন। আমার হাতটি একটু ঢিলা করে দিন। খুব কষ্ট হচ্ছে। নয়তো গুলি করে দিন। এর মধ্যে একজনের একটু দয়া হলো। তিনি আমার হাতের বাঁধন একটু ঢিলা করে দিলেন। অমনি আমি টেবিলের ওপর রাখা গ্রেনেডে থাবা দেই।
আমার ইচ্ছা ছিল, আমি তো মারা যাবই তাহলে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করিয়ে পাকবাহিনী নিয়ে মরব। কিন্তু গ্রেনেডটি ধরতে পারলাম না। এই অপরাধে আমাকে আরও বেশি মারল। যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সেখান থেকে গৌরনদী থানায় নিয়ে কতক্ষণ অত্যাচার করল। দুই-তিন ঘণ্টা পরে গৌরনদী কলেজে মিলিটারি ক্যাম্পে আমাকে, আনোয়ার এবং নৌকার মাঝিকে হস্তান্তর করল।
নিচতলা থেকে যখন দোতলায় উঠানো হচ্ছে তখন এক সুবেদার বলছিল, এমএ জলিল কোথায় বলে দিলে আমাকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু আমি বলিনি। এতে আমাকে পা দিয়ে চেপে ধরে বেয়নেট দিয়ে আমার পুরো শরীর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কাটে। এরপরে দুই কানে জোড়া থাপ্পড় দিতে থাকে। এতে সেখানেই আমার বাম কানটি ফেটে যায়। তখন স্বীকার করি এই টিমের কমান্ডার আমি। এতে আমার ওপর অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। আমার দুই পা বেঁধে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে রাখে। তারপর আবারও নির্যাতন শুরু করে। সন্ধ্যায় গাড়িতে বেঁধে আমাকে বরিশাল ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেলে নিয়ে এল। নিচতলার রুমে রাখল। প্রথম দিনের মতো আমাদের মারধর না করলেও টানা ১৯ দিন এখানে আটকে রেখে লাথি-ঘুষির ওপর রাখত। বরিশাল টর্চার সেলে আমাকে নিয়ে আসে ১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই। ১৮ জুলাই আমাদের দুজনকেই কাপড় মুড়িয়ে রাখে মারা গেছি বুঝে। কারণ আনোয়ার তখন মারা গেছে।
খাবারের মধ্যে বোনের চিঠি :
তিন দিন পর বাসা থেকে খাবার পাঠাল। সেই খাবারের মধ্যে বোনের হাতের লেখা চিঠি পেলাম। চিঠিতে লেখা ছিল, তুমি টেনশন করো না। আমরা তোমাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। এর জবাবও আমি দিয়েছিলাম চিঠিতে। আমি মাকে লিখেছিলাম, মা এখান থেকে আমাকে জীবন্ত বের করার শক্তি পৃথিবীর কারও নেই। তুমি আল্লাহকে ডাকো।
এমজি কবির ভুলু বলেন, আমাকে শেষমেষ হত্যা করল না। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে চালান করে দিল। এখানে অসহ্য জীবন কাটিয়ে ৩ মাস ৬ দিন পর ২১ অক্টোবর পহেলা রমজানের দিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমায় ছাড়া পাই। এরপর বরিশাল ফিরে বিভিন্ন স্থানে ছিলাম। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় ১০ বছর সময় লেগেছে। ওই অসুস্থতার মধ্যেই লেখাপড়া শেষ করেছি। লেখাপড়া শেষ করে একটি এনজিওতে কাজ শুরু করি। ১৯৭৮ সালে বিয়ে করি হিজলা উপজেলার মেহেরুন্নেছা লাইলীকে। আমাদের ঘরে এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তান রয়েছে। বর্তমানে বরিশাল নগরীর শীতলাখোলা এলাকায় থাকি।
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি :
তিনি বলেন, যুদ্ধের পরে মুক্তিযোদ্ধারা অবমূল্যায়িত ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ভাতা চালু হয়েছে। অনুদান দিচ্ছে সরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নের অবদান কেবল শেখ হাসিনার। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সত্যিকারের দরদ দেখিয়েছেন। কী অনুদান পাব তার জন্য তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। তবে যে মূল্যায়ন করেছেন তা স্বীকার করতেই হবে।
এমজি কবির ভুলু বলেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নামের পাশে যখন দেখি কিছু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা স্থান করে নিয়েছে তখন কষ্ট লাগে।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের একটি লক্ষ্য ছিল দেশ হবে অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরে এখনও বঙ্গবন্ধুর সেই অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ে ওঠেনি। আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য তার স্থাপনা সংরক্ষণ করতে হবে। এজন্য বরিশালের ওয়াপদা টর্চার সেলটি পুরোপুরি সংরক্ষণ করা হোক।
৭ মাস ছিল জনগণের যুদ্ধ :
মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহাফুজ আলম বেগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুদ্ধটি ছিল বাংলাদেশের ওপর একটি চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। তবে পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নিপীড়নে অনেক আগে থেকেই বাঙালিরা এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ফলে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ হলেও আমরা সাহসিকতার সঙ্গে তা গ্রহণ করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত একটি গণযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা জয় ছিনিয়ে আনি। সেই সময়ে আমি যুদ্ধে প্রশিক্ষিত ছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তাদের যারা সাধারণ মানুষ যুদ্ধ সর্ম্পকে জানতই না। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য দেখে ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ পাকিস্তান থেকে আমি পালিয়ে আসি। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ শুরু হলো। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা পাব। আমি মুক্তিযুদ্ধের সময়টিকে দুটি ভাগে ভাগ করতে চাই। কারণ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ পর্যায়ক্রমে জনযুদ্ধে রূপ নিল এবং এই যুদ্ধ চলল অক্টোবর পর্যন্ত। নভেম্বর-ডিসেম্বর এই দুই মাসকে আমি আলাদা করে রাখতে চাই। কারণ ওই সময়ে ইন্ডিয়ান এনভায়রনমেন্ট তৈরি হয়। ইন্ডিয়ান মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাঙালিরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন। সহজভাবে বললে, বাঙালি যোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের কোণঠাসা করে ফেলে প্রথম সাত মাসে। পরবর্তী দুই মাসে চূড়ান্ত আঘাত করে তাদের পরাজিত করা হয়।
মূল যুদ্ধটি কিন্তু করেছে সাধারণ মানুষ। কারণ যুদ্ধের একটিই লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার। যা শতভাগ আমরা অর্জন করেছি। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে সুন্দর একটি সম্পর্ক ছিল। তখন আমাদের বাবা-দাদারা সেই সর্ম্পকটি অটুট রাখতে উৎসাহিত করত। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমার মনে হয়, আগে মানুষ ছিলাম। এখন মুসলমান-হিন্দু-খ্রিস্টান হয়ে গেছি।
বরিশাল জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, বরিশাল জেলা ও মহানগর মিলে ৭ হাজার ৩১৭ জন ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। গেজেটভুক্ত সবাই সরকারি ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এখনও অনেকে রয়েছেন যারা গেজেটভুক্ত হতে অনলাইনে আবেদন করেছেন, আবার অনেকে যাছাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে হালনাগাদ তালিকায় দেখা গেছে, বরিশাল সদরে ১৮৭, বানারীপাড়া উপজেলায় ৬৫, গৌরনদী উপজেলায় ১৯১, আগৈলঝাড়া উপজেলায় ৫৬, হিজলা উপজেলায় ১২, মুলাদী উপজেলায় ১০৮, বাবুগঞ্জ উপজেলায় ১৭০, বাকেরগঞ্জ উপজেলায় ৭০, উজিরপুর উপজেলায় ৯০ এবং মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলায় ৯০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে।
এসপি