প্রকল্পের টাকা নয়ছয়, দুদকের মামলার পর কাজ শুরু
ছয় বছর আগে দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এক কোটি টাকা বরাদ্দ পায় বাগেরহাট পৌরসভা। কিন্তু ভবন দুটির কোনো কাজ না করেই ওই টাকা আত্মসাতের দায়ে গত ২৫ নভেম্বর বাগেরহাটের পৌর মেয়র খান হাবিবুর রহমান ও সাবেক সচিব মোহাম্মদ রেজাউল করিমের নামে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মামলার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় বাগেরহাট আবাহনী ক্লাব ও ডায়াবেটিস হাসপাতালের দুটি ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করে পৌর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা করার পর ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ায় বিষয়টিকে মামলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কৌশল হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা।
বিজ্ঞাপন
গত ৩০ নভেম্বর বাগেরহাট শহরের শহীদ মিনার সড়কে পুরতন জেলখানার জমি বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠান দুটির ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করে বাগেরহাট পৌরসভা। সেখানে পৌর মেয়র খান হাবিবুর রহমান ভবন দুটির নির্মাণকাজের লে-আউট প্রদান করেন শীর্ষক সাইনবোর্ড দেওয়া হলেও কাজ শুরুর অনুষ্ঠানে উপস্থি ছিলেন না তিনি।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, খুলনায় (বাগেরহাট) করা মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ পৌর-২ শাখার মাধ্যমে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের সংশোধিত উন্নয়ন বাজেটে প্রকল্প ও বাগেরহাট পৌরসভার উন্নয়ন কাজে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। যার ৫০ লাখ টাকা করে ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় বাগেরহাট ডায়াবেটিস হাসপাতাল কমপ্লেক্স ভবন ও বাগেরহাট আবাহনী ক্লাবের কমপ্লেক্স ভবন (প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ) নির্মাণে। মন্ত্রণালয় থেকে ওই টাকা বরাদ্দের সময় শর্ত ছিল, কোনো অবস্থাতেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্প ও পৌরসভার উন্নয়নমূলক কাজ ব্যতীত অন্য কোনো কাজে ব্যায় করা যাবে না। যথাসময়ে কাজের অগ্রগতি সংশ্লিষ্ট বিভাগে দায়ের করতে হবে এবং অব্যয়িত অর্থ ৩০ জুন ২০১৫ সালের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে।
মামলায় উল্লেখ, রেকর্ডপত্র পর্যালচনায় দেখা যায়, বাগেরহাট পৌরসভার অনুকূলে বরাদ্দকৃত ২ কোটি টাকা স্টান্ডার্ড ব্যাংক লি, বাগেরহাট শাখায় মেয়র, বাগেরহাট পৌরসভা নামে পরিচালিত হিসাব নম্বর ০৬৫৩৬০০০০০৬ এ হস্তান্তরের জন্য মেয়র ও তৎকালীন সচিব স্বাক্ষর করে বিল প্রস্তুত করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের জুনে ওই ব্যাংক হিসাবে মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত টাকা জমা হয়। হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে বিল ছাড় করার পর সে বছরের ২২ জুন বাগেরহাট পৌরসভার তহবিলে জমা করে উত্তোলন করা হয়। তবে ওই টাকা দিয়ে ভবন দুটি নির্মাণ না হওয়ায় দুদক আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করে।
একই দিন দুদক পৌর কর্মচারীদের চাকরি বিধিমালা ভঙ্গ করে এবং নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই ১৭ জনকে নিয়োগ দিয়ে তাদের বেতন-ভাতা বাবদ রাষ্ট্রের ১ কোটি ২৬ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মেয়র ও নিয়োগ পাওয়াদের নামে আরও একটি মামলা করে।
দুদক সূত্রে আরও জানা গেছে, পৌরসভার মালিকানাধীন দোকানঘর, চান্দিনা ও দশানী পৌর পার্ক ভাড়ার জামানত থেকে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা গ্রহণ করা হলেও পৌর তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, দুদকের মামলা করার বিষয়টি বুঝতে পেরে চলতি বছরের অক্টোবরেই বাগেরহাট আবাহনী ক্লাব ও ডায়াবেটিস হাসপাতালের দুটি ভবনের নির্মাণের জন্য এক কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করে পৌরসভা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাগেরহাট পৌরসভার একাধিক বাসিন্দা বলেন, কেবল ওই ভবন নির্মাণই নয়, পৌরসভার বিভিন্ন রাস্তাঘাট নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা নয়ছয় হয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে পৌরসভার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ফলে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। এখন মামলা হওয়ার পরে কাজ শুরু করে পরিত্রাণের পথ খুঁজছেন অভিযুক্তরা।
বাগেরহাট পৌরসভার প্রকৌশলী রেজাউল করিম রিজভি জানান, পৌর শহরের খারদ্বার এলাকার ঠিকাদার মো. নজরুল ইসলাম নিলু আবাহনী ক্লাব ও ডায়াবেটিস হাসপাতাল নির্মাণের কাজ পেয়েছেন। ৫০ লাখ করে মোট এক কোটি টাকা ব্যয়ে ওই ঠিকাদার ক্লাব ও ডায়াবেটিস হাসপাতালের দুটি এক তলা ভবন নির্মাণ করবেন।
পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কান্তি গুহ বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বরাদ্দ হিসেবে পাওয়া এক কোটি টাকা দিয়ে বাগেরহাট পৌরসভার বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে এই কাজ শুরু করা হয়েছে। নির্ধারিত এই জমিতে প্রশিক্ষণ সেন্টারসহ চারতলা বিশিষ্ট আবাহনী ক্লাব ভবন ও আধুনিক ডায়াবেটিস হাসপাতাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। প্রথম পর্যায়ের এই কাজে ভবন দুটির ভিতসহ এক তলা নির্মাণ হবে।
তিনি জানান, ডায়াবেটিস সমিতির এখানে হাসপাতাল ভবনের চারতলা, ছয়তলা ও দশতলা বিশিষ্ট তিনটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসক চেম্বার, পেশেন্ট অপেক্ষা কক্ষ, ল্যাব ও টয়েলেট সুবিধা নির্মাণ করা হবে। বরাদ্দ প্রাপ্তি সাপেক্ষে অন্যান্য কাজ সমাপ্ত করা হবে।
তবে কাজ শুরুতে এত দীর্ঘ বিলম্বের বিষয়ে জানতে চাইলে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন গুহ বলেন, জমি প্রাপ্তিতে কাঙ্ক্ষিত সংস্থাগুলোর সময়ক্ষেপণ এবং কোভিড পরিস্থিতির কারণে কাজ শুরুতে দেরি হয়েছে।
এদিকে প্রায় ৬ বছর আগে টাকা উত্তোলন ও আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হওয়ার পর ভবন নির্মাণের কাজ শুরুর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিস্ময় প্রকাশ করে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, এমন করে মামলা থেকে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউই এত বছর ধরে সরকারের টাকা নিজের কাছে রাখতে পারে না।
দুদকের উপপরিচালক নাজমুল হাসান বলেন, মামলা হওয়ার পর তারা এখন যদি ভবন নির্মাণ করে, তবে তো অভিযোগ প্রমাণিতই হলো। এখানে স্পষ্টভাবে বলা ছিল ওই টাকা তারা অন্য কোনো কাজে ব্যয় করতে পারবে না এবং নির্দিষ্ট সময়ে টাকা ব্যয় না হলে ফেরত দিতে হবে। তারা তা করেননি। দুদক মামলা করেছে। তদন্ত চলছে এবং মামলা চলবে বলেও জানান তিনি।
মোহাম্মদ মিলন/এনএ