রোকেয়া দিবসে থাকছে যেসব আয়োজন
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার ১৪১তম জন্মবার্ষিকী ও ৮৯তম প্রয়াণ দিবস আজ (০৯ ডিসেম্বর)। ১৮৮০ সালের এই দিনে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দের এক নিভৃত পল্লীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এ মহীয়সী নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
নারী জাগরণের অগ্রদূতের জন্ম ও প্রয়াণ দিবসে নারী মুক্তির আন্দোলন বেগবান করার দৃপ্ত শপথে সারাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে বিশেষ ক্রোড়পত্র ও পোস্টার। করোনা মহামারির এই সময়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে।
বিজ্ঞাপন
এবার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখায় দেশের পাঁচজন নারী পাচ্ছেন ‘রোকেয়া পদক’। আজ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেগম রোকেয়া পদক-২০২১ প্রাপ্তরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরার কাছ থেকে সম্মাননা পদক গ্রহণ করবেন।
দিবসটি উপলক্ষে এবার রাজধানী ঢাকাসহ বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির কারণে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নানা আয়োজন করেছে। তবে প্রতি বছর বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান পায়রাবন্দে মেলা বসলেও এ বছর করোনার কারণে তা হচ্ছে না।
এদিকে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় বেগম রোকেয়ার মতো নারী সমাজকে স্বনির্ভর জাতি গঠনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে বেগম রোকেয়ার চেতনা, নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নারীমুক্তি আন্দোলন বেগবান করার আহ্বান জানান তারা।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, বেগম রোকেয়া শুধু নারী শিক্ষার অগ্রদূতই ছিলেন না। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বেগম রোকেয়া তার শাণিত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থা নারী উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। তাই তার চিন্তা-ভাবনা-উদ্বেগ সর্বক্ষণ আবর্তিত ছিল নারী জাগরণ ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে।
নারীকে অবরোধবাসিনী করে বিকলাঙ্গ করার প্রথা উচ্ছেদসহ নারী মুক্তি, নারীর অগ্রযাত্রা ও নারী শিক্ষা প্রবর্তনে তার ত্যাগী ভূমিকা তাকে মহীয়সী করেছে। ‘কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক’ শতবর্ষ আগে এভাবেই বেগম রোকেয়া তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে নারীদের শিক্ষিত তথা আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বেগম রোকেয়ার চিন্তার গভীরতায় এবং দৃষ্টির প্রসারতায় রচিত সাহিত্য আমাদের জাতীয় জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে।
রাষ্ট্রপতি ‘বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘বেগম রোকেয়া দিবস ২০২১’ উদযাপন ও ‘বেগম রোকেয়া পদক’ প্রদানের উদ্যোগকে স্বাগত জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বেগম রোকেয়া উপলব্ধি করেছিলেন সমাজ তথা রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। তার এই উপলব্ধি ও আদর্শ আজও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়।’
রোকেয়া পদকপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে আমি বাঙালি নারী শিক্ষার প্রসার ও নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই। বেগম রোকেয়ার জীবনাচরণ নারী শিক্ষার প্রসারে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসার ও নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পথিকৃৎ।
মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থায় নারীর সমান অধিকারের জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন। রোকেয়া তার মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী ইত্যাদি কালজয়ী গ্রন্থে ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সমাজের কুসংস্কার ও নারীর বন্দিদশার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। বাল্যবিবাহ, যৌতুক, পণপ্রথা, ধর্মের অপব্যাখ্যাসহ নারীর প্রতি অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন। মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে নারীকে গৃহকোণে আবদ্ধ রাখার ধ্যান-ধারণা পাল্টাতে তিনি ছিলেন সদা সোচ্চার। তার দেখানো পথ ধরেই নারীমুক্তি আন্দোলন চলছে।
এদিকে বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় রংপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এছাড়াও সীমিত পরিসরে রংপুর জেলা ও মিঠাপুকুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেলা সাড়ে ১১টায় আলোচনা সভা, দুপুরে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ রোধে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। দুপুর দেড়টায় মিলাদ মাহফিল ও বিকেল সাড়ে ৩টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে।
মিঠাপুকুর পায়রাবন্দে দিবসটির আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রংপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমান। জেলা প্রশাসক আসিব আহসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন- রংপুর জেলার পুলিশ সুপার মো. ফেরদৌস আলী চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু।
এতে আলোচক থাকবেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. সরিফা সালোয়া ডিনা, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ্ আলম, বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মনোয়ারা বেগম, রংপুর প্রেসক্লাব সভাপতি মাহবুব রহমান। স্বাগত বক্তব্য দেবেন মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ জোহরা।
অন্যদিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দিবসটি উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৯টায় কেন্দ্রীয় ক্যাফেটোরিয়া চত্বরে রোকেয়ার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। বিকেল সাড়ে ৩টায় ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. হাসিবুর রশীদ। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. সরিফা সালোয়া ডিনা।
উল্লেখ্য, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় মুসলিম সমাজে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোনো চল ছিল না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও পরিবারের সবার অগোচরে বড় ভাইয়ের কাছে উর্দু, বাংলা, আরবি ও ফারসি পড়তে এবং লিখতে শেখেন।
তার জীবনে শিক্ষা লাভ ও মূল্যবোধ গঠনে তার ভাই ও বড় বোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তীতে বিহারের ভাগলপুরে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। স্বামীর উৎসাহে ও নিজের আগ্রহে তিনি লেখাপড়ার প্রসার ঘটান। বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা যান।
বেগম রোকেয়া ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো-মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি