এএসআই যুগল কুন্ড

বোন শিমু বেগমকে নিয়ে বরিশাল নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান বেল্লাল হোসেন। পটুয়াখালী সদর উপজেলার লোহালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা তারা। বেল্লালের বোনের সিজারিয়ান ও টিউমারের দুটি অপারেশন একসঙ্গে করা হয়। ডাক্তার জানিয়েছিলেন দুই ব্যাগ বি পজিটিভ রক্ত সংগ্রহে রাখতে। রেখেছিলেনও তাই। কিন্তু প্রথম অপারেশনের পর ডাক্তার জানালেন দুই ব্যাগ নয়, মোট ৬ ব্যাগ রক্ত দরকার। অর্থাৎ আরও চার ব্যাগ রক্ত দরকার হবে। 

এতে তিনি যথারীতি বিপদে পড়ে যান। বোন অপারেশনের টেবিলে। এমন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক চার ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করা ছিল অসাধ্য। তখন রক্ত চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেন বেল্লালের এক স্বজন। পোস্টটি নজরে পড়ে বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) যুগল কুন্ডুর। একজন রক্তদাতা সংগ্রহ করে ছুটে যান হাসপাতালে। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকজন রক্তদাতা সংগ্রহ করেন। 

বেল্লাল হোসেন বলেন, তাকে (যুগল কুন্ডু) কখনো চিনতাম না। কিন্তু রক্ত সংগ্রহ করে দিয়ে আমাদের পরিবারের স্বজন হয়ে গেছেন। শুধু রক্ত দিয়েই শেষ নয়, প্রতিদিনই বোনের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিয়েছেন তিনি। ধরতে পারেন, স্যার এখন আমাদের রক্তের বান্ধব। 

শুধু বেল্লাল হোসেন নয়, এমন অসংখ্য মানুষের জন্য নিজে রক্ত দিয়েছেন কিংবা সংগ্রহ করে দিয়েছেন এএসআই যুগল কুন্ডু। পুলিশ হিসেবে অপরাধ দমনে যেমন কাজ করে যাচ্ছেন, তেমনি নিজের মানবিক কাজের মাধ্যমে ‘রক্তের আত্মীয়’ হয়ে আছেন তিনি।

যুগল কুন্ডু জানান, নিজের শরীর থেকে এখন পর্যন্ত ২২ জনকে রক্ত দিয়েছেন। আর বরিশালেই কমপক্ষে ৮০০ জনের জন্য রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছেন। রক্ত দিতে গিয়ে সুখকর স্মৃতিও রয়েছে আবার কষ্টেরও স্মৃতি আছে তার।

এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন,  ২০০৪ সালে পুলিশ সদস্য হিসেবে যখন কাজে যোগ দেই, তখন থেকেই চেষ্টা করছি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। কারণ পুলিশের পেশাটা মূলত সেবামূলক। তাছাড়া মানুষ দুই রকমভাবে মানুষকে মনে রাখে। ভালো কাজের জন্য আর খারাপ কাজের জন্য। হাসপাতালে গেলে দেখা যায় এক ব্যাগ রক্তের জন্য মানুষ কতটা অসহায়। কেউ কেউ হয়তো স্বজন হারিয়ে ফেলেন। আসলে স্বজন হারানোর ব্যথা পৃথিবীর কোনো ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। অথচ মানুষ চাইলে সেই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে মানুষকে সাহায্য করতে পারে। একবেলা খেতে না পারলে হয়তো মানুষ মারা যাবে না কিন্তু এক ব্যাগ রক্তের জন্য আমরা কাউকে হারিয়ে ফেলি।

যুগল কুন্ডু বলেন, প্রতি তিন মাস পর শরীরে নতুন রক্ত জন্ম নেয়। যেহেতু আমাদের শরীরে রক্ত জন্ম নেয় সেজন্য অপরকে রক্ত দিয়ে সহায়তা করা সম্ভব। আমার যে রক্ত কনিকা মরে গিয়ে নতুন রক্ত কনিকার জন্ম হবে সেই রক্ত দিয়ে অপরের রক্তের চাহিদা পূরণ করা অসাধ্য কিছুই নয়। ইচ্ছা শক্তি থাকলেই মানুষ তা পারে। এই চিন্তা থেকে পুলিশে যোগদানের শুরুর দিন থেকে আমি রক্তদানে নিজেকে নিয়োজিত করি।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৩-৪ জন পুলিশ সদস্যের জন্য রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছি। তবে বেশিরভাগ রক্ত সংগ্রহ করেছি দরিদ্র-অসহায় মানুষের জন্য। এমনও হয়েছে নিজের পকেটের টাকায় রক্তের ব্যাগ কিনে নিয়ে গেছি। পানি কিনে নিয়ে গেছি রক্তদাতার জন্য। 

মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দেওয়ার পর যখন সেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠে জড়িয়ে ধরেন বা কথা বলেন, তার চেয়ে আর সুখের কী হতে পারে প্রশ্ন তুলে এএসআই যুগল কুন্ডু বলেন, বিপরীত পরিস্থিতিও আছে। রক্ত দিয়ে বা রক্তদাতা নিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে দেওয়ার পরে যাদের রক্তের দরকার ছিল তাদের খুঁজে পাই না। জানি না তাদের মনে কিসের ভয়, হয়তো ভাবে রক্ত সংগ্রহ করে দিলে আমাকে বিনিময়ে কিছু দিতে হবে। তখন কার কাছে রক্ত রেখে আসবো বা কেউ একটু এসে কথা বলে ধন্যবাদ দেবে সেই মানুষও পাওয়া যায় না। তখন হয়তো হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে রোগীর নাম লিখে রেখে আসতে হয়। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার। 

আবার কষ্ট লাগে তখন, যখন রক্ত সংগ্রহ করা হয়ে গেছে কিন্তু জানতে পারলাম যার জন্য রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে তিনি আর পৃথিবীতে নেই। এভাবে এক মায়ের জন্য রক্ত সংগ্রহ করে অপেক্ষা করছিলাম। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে আছি তাদের কল পাওয়ার জন্য। দুপুরে রক্ত সংগ্রহ করে বসে আছি, সেই নারীর বাবা বিকেলে কল করলেন আমার মোবাইলে। আমি কিছুটা ব্যথিত ছিলাম তাদের দায়িত্বহীনতার জন্য। কিন্তু কল করে তিনি জানালেন, যার জন্য রক্ত সংগ্রহ করেছি তিনি আর বেঁচে নেই। পাশাপাশি জানালেন, লাশ বাড়িতে নেওয়া আর কাফনের কাপড় ক্রয়ের কোনো টাকাও নেই তার কাছে। এর থেকে বেশি কষ্ট আর পাইনি। শেষে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই অভাগা বাবাবে সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা সংগ্রহ করে দিয়ে তার মেয়ের দাফনের ব্যবস্থা করেছিলাম।

যুগল কুন্ডু বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করি। আমাদের বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলা বন্ধুর বন্ধন-৯৮ ব্যাচ, আমরা রক্ত দানের অপেক্ষায় কিংবা আমার ছোটবোন সমতূল্য স্বেচ্ছাসেবক তাসনিমসহ বিভিন্ন রক্তদাতা সংগঠন থেকে রক্ত সংগ্রহ করি। ফেসবুকে পোস্ট করেও রক্ত সংগ্রহ করা হয়। যারা স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি বা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত তারা আমার সঙ্গে কাজ করে আনন্দ পায়। কারণ তারা দেখছেন একজন পুলিশ সদস্য সাধারণ মানুষের জন্য রক্ত সংগ্রহ করছেন। এতে অনেকেই উৎসাহিত হয়। 

মূলত আমি ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটির দ্বারা অনুপ্রাণিত উল্লেখ করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর হার্ট অ্যাটাক করি। এজন্য ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া আমি রক্ত দিতে পারি না। তবে রক্ত সংগ্রহের কাজ থেমে নেই। আমি নিজে রক্ত দিতে না পারলেও বিপদে পড়া মানুষদের জন্য রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েতো উপকার করতে পারি। আর এভাবেই জীবনে যতদিন বেঁচে থাকবো মানুষের উপকার করে যেতে চাই।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরা মানবিক কাজে যুক্ত হচ্ছেন। যেমন পুলিশ সদস্য যুগল কুন্ডু স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত। তার কাছে অসহায়, গরিব কিংবা বিপদগ্রস্ত যে কেউ রক্তের জন্য সাহায্য চাইলে তা সংগ্রহ করে দেন। কিংবা কারো রক্তের প্রয়োজন জানতে পারলে তিনি নিজ উদ্যোগে তা সংগ্রহ করেন। এই কাজটি কিন্তু তিনি পেশার বাইরে ব্যক্তি উদ্যোগে সমাজের মানুষের কল্যাণে করছেন। এভাবে আরও অনেক পুলিশ সদস্য যার যার স্থান থেকে পেশার বাইরেও মানুষের উপকার করছেন।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর