ইউএনওর শুনানিতে খুশি ভুক্তভোগীরা
মানবিকতা ও উদারতার এক অনন্য উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ নুসরাত জাহান। গত বছরের ১৩ জুলাই রূপগঞ্জে যোগদানের পর থেকেই মানবসেবায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। অশিক্ষার অন্ধকার দূর করে উপজেলায় আলো ছড়াচ্ছেন। নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধেও তৎপর থাকেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন এই ইউএনও।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় রূপগঞ্জে অসহায়দের জন্য মোট ৩০৩টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একেকটি পরিবারের জন্য ২ শতক জমি ও ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে টিনশেডের দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। উপজেলার ২৯৫টি পরিবার ইতোমধ্যে স্বপ্নের এই ঘরে বসবাস শুরু করেছেন। ঘরে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে আরও ৮-৯টি পরিবার।
বিজ্ঞাপন
রূপগঞ্জ উপজেলায় ঘর পাওয়াদের মধ্যে একজন ৭০ বছর বয়সী রুনা বেগম। তার স্বামী মারা গেছেন বহুদিন আগে। ছিল না থাকার কোনো ঘর। ভিক্ষা করে ও গৃহকর্মীর কাজ করে এক ছেলে ও এক মেয়েকে বড় করেছেন। বহু কষ্টে মেয়েকে বিয়েও দিয়েছেন। ছেলে কাদির বিয়ে করে চলে গেছেন ঢাকায়। ছেলে চলে যাওয়ার পর থেকে রুনা বেগমকে অন্যের বাড়ির বারান্দাতে থাকতে হয়েছে। তিনি কখনো ভাবেননি নিজের জমিতে, নিজের ঘরে থাকতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় রুনা বেগম নিজের নামে দুই শতক জমি ও ঘর পেয়েছেন। বিদ্যুৎ সংযোগ ও পানির ব্যবস্থাও করা হয়েছে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে ঈদের আনন্দও উপভোগ করেন। তিনি এতিম শিশুদের নিয়ে জন্মদিনসহ নানা উৎসব পালন করেন। উপজেলার এতিম-অসহায় শিশুদের দিকে খেয়াল রাখা নৈতিক দায়িত্ব মনে করেন এই ইউএনও।
এদিকে করোনাকালে অনলাইন ক্লাস চালু রাখতে উপজেলার প্রায় প্রতিটি স্কুলের প্রতি নজর রাখেন ইউএনও। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে এখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। রূপগঞ্জের ৩২টি স্কুলে শিক্ষার্থীদের মনিটরিংয়ের জন্য কিশোর পরামর্শ কেন্দ্র (এডোলসেন্ট কাউন্সেলিং সেন্টার) স্থাপন করা হয়েছে। এতে বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের নানা সমস্যার কথা জেনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে।
অন্যদিকে ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান উপজেলার রূপগঞ্জ, মুড়াপাড়া, ভোলাব, গোলাকান্দাইল, ভুলতা, কায়েতপাড়া ও দাউদপুর ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংস্কারে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। গত অর্থবছরে উপজেলায় ১৭টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
উপজেলাকে মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত করতেও কাজ করে যাচ্ছেন ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান। রূপগঞ্জের কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান তিনি। ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান রূপগঞ্জে যোগদানের পর ইতোমধ্যে উপজেলায় ৬টি ইউনিয়ন পরিষদ ও একটি পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কায়েতপাড়া ইউনিয়নে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতাকে ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান দেখছেন ভিন্নভাবে।
তিনি বলেন, এখানকার সহিংসতাগুলো মূলত আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হয়েছে। ঘটনার পর ওই এলাকার লোকজনের সার্বিক নিরাপত্তায় উপজেলা প্রশাসন জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারার ব্যবস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে অপরাধ প্রতিরোধ করা হয়েছে। নাওড়া এলাকায় সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
জানা গেছে, দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান। করোনাকালে গভীর রাতেও উপজেলার অলিগলিতে ঘুরে হতদরিদ্রের মাঝে খাবার বিতরণ করেছেন। গত রমজান মাসে রাস্তায় হতদরিদ্রদের মাঝে সাহরি বিতরণ করেছেন তিনি। পত্রপত্রিকায় বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো অসহায় মানুষের খবর পেলেই ছুটে যান তার কাছে। নিজ কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে মানুষের নানা ধরনের সমস্যার সমাধানও করেন। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগ গ্রহণ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়। সপ্তাহে একদিন (প্রতি বুধবার) অভিযোগ শুনানির ব্যবস্থা নেয় উপজেলা প্রশাসন। এসব লিখিত অভিযোগের ৮০ শতাংশই সমাধান করে দেন ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান। কিছু অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রেরণ করেন।
গত বুধবার (১ ডিসেম্বর) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে রিয়া মনি (১৮) নামে গৃহবধূ তার ২ মাসের সন্তান ও মাসহ এসেছিলেন শুনানির জন্য। গত ১ নভেম্বর তিনি লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন তার স্বামী ও তিন ননদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে। কাঞ্চন চৌধুরীপাড়া এলাকার মাদকাসক্ত নাইম চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় তার। স্বামীর বাড়িতে প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন রিয়া মনি। আট মাসের গর্ভবতী অবস্থায় স্বামী ও ননদরা মারধর করে তাকে ঘর থেকে বের করে দেন। তাদের বাড়িতে এসেও স্বামী নাইম মারধর করেন।
রিয়া মনি বলেন, লিখিত অভিযোগ জানানোর সময় আমি অনেক অসুস্থ থাকার কারণে ইউএনও ম্যাডাম আমাকে প্রথমে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠান। এখন সন্তানসহ চিকিৎসা শেষে আমি শুনানির জন্য এসেছি। ম্যাডামের কারণে শ্বশুরবাড়িতে আমার সঠিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
গত বছরের ৪ অক্টোবর স্বামীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন নগরপাড়া এলাকার এক নারী। তার অভিযোগ- স্বামী তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে ঘর তালাবদ্ধ করে দিয়েছেন। অভিযোগটি পেয়ে ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান ওই এলাকার ইউপি সদস্যকে ফোন করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ওই নারী ইউএনওর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চিঠি পাঠান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রূপগঞ্জে পারিবারিক কলহ, বিবাহবিচ্ছেদ, বাল্যবিবাহ, মাদকের আগ্রাসন, আধিপত্য বিস্তার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ হামলা ভাঙচুরের প্রচুর ঘটনা ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব সমস্যার সমাধান করা হয় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে। করোনাকালীন পরিস্থিতিসহ এ সময়ের মধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩০টিরও অধিক বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া মাদকাসক্তদের বিষয়ে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করে উপজেলা প্রশাসন। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন মাদকাসক্তদের পুলিশে দিয়ে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা নেন ইউএনও।
করোনাকালে ব্যবসায়ীরা যাতে পণ্যের দাম বেশি নিতে না পারেন সে জন্য ইউএনও শাহ নুসরাত জাহান প্রতিনিয়ত উপজেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখেছেন। করোনার বিস্তার রোধে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে প্রতিদিন মাঠে থেকেছেন তিনি। করোনায় মৃতদের মরদেহ দাফন, করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষার দিকেও নজর রেখেছেন তিনি। করোনাকালে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে বাজার মনিটরিং, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিক্রিতে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণসহ নানা ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপজেলাজুড়ে মানবিক ইউএনও হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন শাহ নুসরাত জাহান।
এ বিষয়ে রূপগঞ্জের সমাজসেবক লায়ন মীর আব্দুল আলীম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শাহ নুসরাত জাহান একজন মানবিক ইউএনও। তিনি রূপগঞ্জ উপজেলায় যোগদানের পর থেকেই এখানে মানবসেবামূলক কর্মকাণ্ড সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন, ইউনিয়ন ও পৌর এলাকাগুলোর উন্নয়ন, এতিম অসহায় ও নির্যাতিতদের সহযোগিতাসহ প্রতিটি সামাজিক কাজে অবদান রেখে চলেছেন তিনি।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউএনও শাহ নুসরাত জাহানের কাছ থেকে আমরা উপজেলার সমাজসেবা বিষয়ক সব ধরনের সহযোগিতা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে পাই। আর প্রতিটি কাজই উনি খুব দরদ দিয়ে করে থাকেন। বিশেষ করে সেবা ও উন্নয়নমূলক কাজে সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে তিনি খুবই তৎপর থাকেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ নুসরাত জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিজের প্রচারের জন্য নয়, দায়িত্ববোধ থেকেই মানব কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। আমি রূপগঞ্জে বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, উপজেলাবাসীর উন্নত মানসিকতা তৈরি ও সামাজিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাব। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব তা করা হবে। দেশের ভবিষ্যতের জন্য এখানকার মেধাবী শিক্ষার্থীদের দিকে নজরদারিসহ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে যাব।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুসরাত জাহান সরকারি উন্নয়নমূলক কাজগুলো খুবই ভালোভাবে করছেন। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে সামাজিক উন্নয়ন ও মানবসেবায় বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। একই সঙ্গে এলাকার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূল, বাল্যবিবাহ রোধসহ নানা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতেও তিনি তৎপর রয়েছেন।
আরএআর