নীলফামারীতে আটক ৫ জঙ্গির বিষয়ে র্যাব
গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল স্থাপনায় বোমা হামলার ছক করছিল জঙ্গিরা
নীলফামারী থেকে আটক হওয়া পাঁচ জঙ্গি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) দিয়ে বোমা হামলা চালিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি এবং শীর্ষ জঙ্গিদের জেল থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করছিল। এ তথ্য জানিয়েছেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে তিনি জানান, এ জঙ্গিরা জেএমবির সামরিক শাখার সদস্য। ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েব পেজ দেখে তারা দীর্ঘদিন ধরে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেয়। মূলত জেলখানায় অন্তরীণ থাকা শীর্ষ জঙ্গিদের আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথে হামলা চালিয়ে মুক্ত করাই ছিল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার লক্ষ্যে তারা এসব অত্যাধুনিক বোমা তৈরি করে।
বিজ্ঞাপন
শনিবার (৪ ডিসেম্বর) বিকেলে র্যাব-১৩ এর রংপুর সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। এর আগে মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে নীলফামারী সদর উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের পুটিহারি মাঝাপাড়া গ্রামে শরিফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে জঙ্গি সন্দেহে পাঁচজনকে আটক করে র্যাব।
আটক হওয়া ব্যক্তিরা হলো- সদর উপজেলার উত্তর মুশরত কুখাপাড়া গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে আহিদুল ইসলাম আহিদ ওরফে পলাশ (২৬), তার ভাই জাহিদুল ইসলাম জাহিদ ওরফে জোবায়ের (২৭), একই উপজেলার পশ্চিম কুচিয়ামোড় পাঠানপাড়া গ্রামের ওয়াজ্জুউদ্দীন মাসুদের ছেলে ওয়াহেদ আলী ওরফে আব্দুর রহমান (৩০), দক্ষিণ বালাপাড়ার তছলিম উদ্দিনের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডা. সুজা (২৬) এবং সোনারায় কাচারীপাড়ার মৃত রজব আলীর ছেলে নূর আমিন ওরফে সবুজ (২৮)।
এদের মধ্যে আহিদ নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির রংপুর অঞ্চলের সামরিক শাখার প্রধান। অভিযানের সময় উদ্ধার হওয়া একটি শক্তিশালী বোমা নিষ্ক্রিয় করেছে র্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট।
খন্দকার আল মঈন বলেন, আটক হওয়া ব্যক্তিরা সবাই জেএমবির সামরিক শাখার সদস্য। তাদের মধ্যে ওয়াহেদ আলী বোমা তৈরির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। শরিফুলও জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অভিযানের বিষয়টি টের পাওয়ায় সে পালিয়ে যায়। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
তিনি আরও বলেন, অভিযানে বোমা তৈরির সরঞ্জাম, বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য, একটি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়েছে। আটক হওয়া জঙ্গিরা সামরিক শাখার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আইইডি তৈরি, আইইডি তৈরি করার প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন এবং নাশকতামূলক হামলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। দুই-তিন মাস পূর্বে আহিদের বাড়িতে আইইডি বোমা তৈরির সময় গভীর রাতে বোমা বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জঙ্গিরা অনলাইনে রংপুর অঞ্চলের আমিরের নির্দেশনায় বেশ কয়েক দিন যাবত আইইডি তৈরি করে তাদের সহযোগী মাঝাপাড়া গ্রামের শরীফুল ইসলামের বাড়িতে রাখে। বোমা তৈরির পাশাপাশি তারা সাংগঠনিক কার্যক্রমে রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রায় ২০-২৫ জনকে জঙ্গি সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানতে পেরেছে, জঙ্গি আহিদ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। সে একটি খেলনা প্রস্তুতকারক কোম্পানির কোয়ালিটি চেকার পদে চাকরি করে। ২০১৫ সালে জেএমবিতে যোগ দিয়ে রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক নেতার কাছ থেকে বায়াত (শপথ) গ্রহণ করে। আহিদ রংপুর অঞ্চলে জেএমবির সামরিক শাখার কার্যক্রম পরিচালনা করত। অপর জঙ্গি সদস্যরাও বিভিন্ন পেশার আড়ালে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা জঙ্গি আহিদের মাধ্যমে ২-৩ বছর আগে জেএমবির কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ২ হাজার ৬৫৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। যাদের মধ্যে ১ হাজার ৩৮৯ জন নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য। র্যাবের অভিযানে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আব্দুর রহমানের ভাই, আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়ালসহ বেশ কয়েকজন জঙ্গি নেতা গ্রেফতার হন। ২০০৭ সালে তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। এছাড়া হলি আর্টিসান ঘটনার পর র্যাবের তৎপরতায় আরও ১ হাজার ৪৯৬ জঙ্গি সদস্য গ্রেফতার হয়। যার মধ্যে ৮১৬ জন জেএমবির সদস্য।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক এএসপি আ ন ম ইমরান খান, র্যাব-১৩ এর অধিনায়ক কমান্ডার রেজা আহমেদ ফেরদৌসসহ ব্যাটালিয়নের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে ঢাকা পোস্টের নীলফামারী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, র্যাব যে বাড়ি থেকে বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে, সেটি মৃত সুলতান আলীর নাতি শরিফুল ইসলামের বাড়ি। শরিফুল পেশায় রাজমিস্ত্রি। দুই বছর ধরে শরিফুলের চলাফেরায় বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পলাতক শরিফুলের স্ত্রী ও তার শাশুড়িকে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
নীলফামারী সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুর রউপ বলেন, শরিফুল ইসলামের বাড়িটি তদন্তের স্বার্থে স্থানীয় আনসার ও গ্রাম পুলিশ সদস্যদের পাহারায় রাখা হয়েছে। এছাড়া পলাতক শরিফুল ইসলামকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর/জেএস