দুই বিঘার পেয়ারাবাগান এখন ২০০ বিঘায়
২০১৫ সালে বাড়ির পাশে নিজের দুই বিঘা জমিতে শুরু করেন পেয়ারা চাষ। শুরুতে বিনিয়োগ করেন দুই লাখ টাকা। বছর শেষে পেয়ারা বিক্রি করেন ১০ লাখ টাকার। তারপর থেকে সিদ্ধান্ত নেন এখানেই থিতু হবেন। বাড়াতে শুরু করেন পেয়ারা বাগানের পরিধি। ২০০ বিঘায় ৯টি বাগানে পেয়ারা চাষ করে তিনি এখন জেলার সবচেয়ে বড় পেয়ারা উৎপাদনকারী।
শুধু বাগানই নয়, ভিটামিন-খনিজ উৎপাদনের মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশের পুষ্টিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন কর্মসংস্থান। প্রতিদিন গড়ে দেড় শ মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন তিনি। এ ছাড়া আফাজের বাগানের পেয়ারা নাটোর ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
বিজ্ঞাপন
সফল উদ্যোক্তা পেয়ারাচাষি আফাজ আলীর বাড়ি নাটোর সদর উপজেলার চন্দ্রকোলা রুয়েয়েরভাগ গ্রামে। কৃষক পরিবারে ১০ ভাইবোনের আর্থিক টানাপোড়েনের সংসারে সবার ছোট আফাজ আলী। আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্যবসায়ের হাতছানির কারণে পড়াশোনাকে এগিয়ে নিতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। গ্র্যাজুয়েট হতে না পারার অতৃপ্তি এখনো তাড়া করে ফেরে তাকে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসার অভিজ্ঞতা থেকে একসময় শুরু করেন চাল ব্যবসা। এ ব্যবসায় মুনাফা থাকলেও একসময় হাল ছেড়ে দেন। বারবার ব্যবসায়ের পরিবর্তন শেষে পেয়ারা চাষেই থিতু হন তিনি। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে পেয়ারা যেহেতু তাকে এনে দিয়েছে সাফল্য, তাই এখন পেয়ারাই তার ধ্যান-জ্ঞান।
জানা যায়, নাটোর সদর উপজেলার তেবাড়িয়া, ছাতনী, আগদিঘা, বড়হরিশপুর ইউনিয়ন পেরিয়ে আফাজের পেয়ারা বাগান এখন সিংড়া উপজেলার হাতিয়ানদহে। দুই শতাধিক বিঘার মোট ৯টি বাগানজুড়ে পেয়ারা চাষ করে তিনি এখন জেলার সবচেয়ে বড় পেয়ারা উৎপাদনকারী।
এমনিতেই নাটোর ফল উৎপাদনের সূতিকাগার। নাটোরের অসংখ্য ফল উৎপাদক সারা দেশে নন্দিত হয়েছেন ইতোপূর্বে। তাদের উৎপাদনের ক্ষেত্র কখনো একটা মাত্র ফলে সীমিত থাকেনি। প্রত্যেকেই রকমারি ফল উৎপাদন করেন। ব্যতিক্রম শুধু আফাজ আলী। তার ক্ষেত্র শুধুই পেয়ারা। নাটোর সদর উপজেলার শংকরভাগ এলাকার এক জায়গায় ১২০ বিঘা ও অন্যান্য জায়গায় ৮০ বিঘায় পেয়ারা-বাগান গড়ে তোলেন আফাজ আলী।
আফাজ আলী থাই-৩ জাতের পেয়ারা চাষ করেন। তার প্রতি বিঘায় গাছ রয়েছে ২০০টি করে। সাধারণত এক বছরের মাথায় ফলন পাওয়া যায়। প্রতিটি গাছের বার্ষিক ফলন এক মণের কাছাকাছি। বারো মাস ফলন পাওয়া গেলেও পেয়ারের মৌসুম মূলত আশ্বিন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস। তবে উচ্চ মূল্য ও সময় হিসেবে পৌষ ও মাঘ মাসসহ অগ্রহায়ণ ও ফালগুনের অর্ধেকটা সময় ব্যবসায়ীদের কাছে পেয়ারা বাজারজাতকরণের কাঙ্ক্ষিত সময়। আফাজের বাগানের পেয়ারা নাটোর ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
আফাজ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে আমি নার্সারি ও চালের ব্যবসা করতাম। এক বন্ধুর পেয়ারা চাষ দেখে আমি উদ্বুদ্ধ হই। প্রথমে আমি দুই বিঘা জমিতে চাষ শুরু করি। অন্য কোনো ফল নয়, পেয়ারাই আমার ধ্যান-জ্ঞান। ৯টি বাগানে প্রতিদিন গড়ে দেড় শ মানুষ কাজ করে। তাদের গাছ রোপণ, আগাছা নিধন, সার দেওয়া, সেচ, পেয়ারার ব্যাগিং কাজের দিকনির্দেশনা দিয়েই আমার বাগানে দিন কাটে।
পেয়ারা চাষ করছি আর ক্রমেই অনেক অজানাকে জানছি। আমার মতো করে আমি প্রযুক্তি আবিষ্কার করছি। উৎপাদনের মান বাড়াতে আমার অদম্য চেষ্টা। নাটোরকে পেয়ারার জেলা হিসেবে পরিচিত করতে চাই।
তার একটি পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ করব। যেমন: পেয়ারা থেকে জুস, টমেটো থেকে সস, আম থেকে জুস, হলুদ থেকে হলুদের গুঁড়া, মরিচ থেকে মরিচের গুঁড়াসহ অনেক কিছু। সরকার যদি আমাকে সহযোগিতা করে বা কোনো সরকারি প্রশিক্ষণ পাই, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যে শুরু করব বলে আশা করি।
বাগানে কাজ করা শ্রমিক শাকিল মাহমুদ বলেন, পেয়ারার বাগানে কাজ করছি। আমরা এখানে ১৫০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছি। সবার সংসারে উন্নতি আসছে এবং সবাই ভালোমতো চলতে পারছি। আমরা বাগানে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকি।
শ্রমিক মো. শাহ আলম মিয়া জানান, আমি পেয়ার-বাগানে শুরু থেকে কাজ করছি। মাসে ৯ হাজার টাকা বেতন পাই। আমাদের এখানে প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বাগানে কাজ করি।
ঢাকার কাওয়ানবাজারের ‘মা ফলভান্ডার’ স্বত্বাধিকারী ও ব্যবসায়ী আলী জানান, নাটোরের আফাজের পেয়ারা খুবই ভালো। এলাকায় তার পেয়ারার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গুণগত মানেও খুব ভালো। তাই আমি আফাজের বাগানের পেয়ারা গাড়িযোগে ঢাকায় এনে বিক্রি করি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মাহমুদুল ফারুক বলেন, পেয়ারার বাগান সৃষ্টির মাধ্যমে আফাজ শুধু নিজের আর্থিক সমৃদ্ধিই অর্জন করেননি, শত মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, সর্বোপরি দেশের মানুষের পুষ্টির অভাব পূরণের মাধ্যমে অবদান রাখছেন। নাটোরের উৎপাদিত ফল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ হচ্ছে। কৃষি বিভাগ পেয়ারা উৎপাদনের নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পরামর্শ দিয়ে সব সময় আফাজের পাশে আছে। আমরা সব সময় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করি ফল চাষের জন্য।
এনএ