ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার মধ্যে দিয়ে তৃতীয় ধাপে দেশের এক হাজার ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ধাপে ৩৩টি ইউপিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এবং বাকিগুলোতে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। রোববার (২৮ নভেম্বর) সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে বিকেল ৪টায় শেষ হয়। এখন ভোট গণনা চলছে। 

এদিকে তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন চলাকালে ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা ও দুই পক্ষের মধ্য ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভোট বর্জনেরও খবর পাওয়া গেছে।  ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কুমিল্লা

কুমিল্লার বরুড়ার একটি ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সারোয়ার ভূঁইয়া এবং পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আবু হানিফকে ছুরিকাঘাত করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ওই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। রোববার (২৮ নভেম্বর) বেলা ১১টায় উপজেলার ঝলম ইউনিয়নের ডেউয়াতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।

আহত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সারোয়ার ভূঁইয়া বলেন, দুই সদস্য প্রার্থীর লোকজন কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করে। এ সময় বাধা দিলে তারা আমার ওপর হামলা করে। আমি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছি। আমার হাতে ১১টি সেলাই দেওয়া হয়েছে। 

বরুড়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল বাহার জানান, দুর্বৃত্তদের হামলায় পুলিশের এক সদস্যসহ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ওই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।

মৌলভীবাজার

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভূকশিম‌ইল ইউনিয়নের কানেহাত ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। রোববার (২৮ নভেম্বর) দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে কানেহাত ভোটকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। 

কানেহাত ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জয়ন্ত মালাকার বলেন, দুষ্কৃতকারীরা হঠাৎ হামলা করে পুরুষ কক্ষের ব্যালট পেপার ছিনতাই করে। পরে পুলিশের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হয়। এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। বিষয়টি ওপর মহলে জানিয়েছি। পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার ভোটগ্ৰহণ শুরু হবে। ইউপি সদস্য প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে।

ভোলা

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন চর কুকরী মুকরী ইউনিয়নে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে ভোট ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়ার প্রতিবাদ করায় মোটরসাইকেল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. কবির হোসেনের ওপর হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা। এতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ১০ জন আহত হয়েছেন।

জানা যায়, চর কুকরী মুকরী ইউনিয়নের আমিনপুর ৫ নম্বর ওয়ার্ড, হাজিপুর ২ নম্বর ওয়ার্ড ও মুসলিমপাড়া ৭ নম্বর ওয়ার্ড ভোটকেন্দ্রে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কর্মীরা। এতে বাধা দেওয়ায় মোটরসাইকেল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. কবির হোসেনের ওপর হামলা চালান ওই ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল হাসেম মহাজনের সমর্থিত কর্মীরা।

স্বতন্ত্র প্রার্থীর বোন নাসরীন আকতার মাসুমা অভিযোগ করে বলেন, ১২ নম্বর চর কুকরী মুকরী ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল হাসেম মহাজন ভোটকেন্দ্রর বুথ থেকে আমার ভাই স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের হুমকি-ধমকি দিয়ে বের করে দিয়ে নৌকা প্রতীকে প্রকাশ্যে ভোট দিয়েছেন। তাদের বাধা দিলে আমার ভাইয়ের ওপর হামলা চালায়। তাকে বাঁচাতে গেলে তার কর্মীদের ওপরও হামলা করা হয়। 

গাইবান্ধা

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে একটি ভোটকেন্দ্র দখল ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পুলিশ ১২ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ।

রোববার (২৮ নভেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের বৌলজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, দুপুর ১২টার দিকে বৌলজান কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে চারটি কক্ষের ব্যালট পেপার ছিনতাই করে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী মো. মহাসিন আলীর সমর্থকরা। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলি চালায়। এ ঘটনায় কনস্টেবল মোমিনুল ও মাহবুব মিয়া আহত হয়েছেন। এছাড়া তিনজনকে আটকের খবর পাওয়া গেছে।

বৌলজান কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তসলিম উদ্দিন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ঘটনার পর কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছে। ব্যালট উদ্ধারে কাজ করছে পুলিশ।

লক্ষ্মীপুর

লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ভাদুর ইউনিয়নের সমেষপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গোপন বুথে ঢুকে ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে নৌকায় ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এজেন্টসহ সমর্থকদের বিরুদ্ধে। কয়েকজন ভোটারকে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করারও রয়েছে। 

এ সময় ছবি তুলতে গেলে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বাধা দেন। ফরিদ উদ্দিন রামগঞ্জ সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক।

বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পুরুষ বুথে কোট পরা একজন লোক কালো পর্দার ভেতরে থাকা লোককে নৌকা ভোট দেওয়ার জন্য বাধ্য করছেন। এ সময় কক্ষের বাইরে থেকে ছবি তুলতে গেলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এসে সাংবাদিকদের বাধা দেন।

এ কেন্দ্রে ২ হাজার ৪৭ ভোটার রয়েছেন। পুরুষ ১ হাজার ৫০ ও ৯৯৭ জন নারী ভোটার। কেন্দ্রের বাইরে সকাল থেকেই ভোটারের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান প্রার্থীর জাহিদ হোসেন ভূঁইয়া (আনারস) ও হাতপাখার প্রার্থীর কোনো এজেন্ট ছিল না। 

এ ব্যাপারে মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ভেতরে ছবি তুলবেন না। কোনো সমস্যা হলে আমরা ব্যবস্থা নেব। কারণ জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে তর্কে জড়ান। সাংবাদিকদের ভোটকক্ষে প্রবেশের অনুমতিও দেননি তিনি।

চেয়ারম্যান প্রার্থী জাহিদ হোসেন ভূঁইয়ার অভিযোগ করে বলেন, সমেষপুর কেন্দ্রসহ ৪ কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রেই ব্যালট ছিনয়ে নিয়ে নৌকায় ভোট দেওয়া হচ্ছে।

নরসিংদী

নরসিংদীতে ইউপি নির্বাচনে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সদর উপজেলার নজরপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে রোববার (২৮ নভেম্বর) সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত লাঠিসোটা ও টেঁটা নিয়ে সংঘর্ষ চলে বলে জানা গেছে।

নজরপুর ইউনিয়নের দুই প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীরা হলেন- আনারস প্রতীকের জালাল উদ্দিন সরকার এবং নৌকা প্রতীকের সাইফুল হক স্বপন।

জানা গেছে, ২৮ নভেম্বর সকালে ভোট শুরুর কিছুক্ষণ পরই চেয়ারম্যান পদে নৌকা এবং আনারস প্রার্থীর সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। দুই পক্ষই কেন্দ্রে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। পরে ভোটকেন্দ্রের বাইরে টেঁটা ও লাঠিসোটা নিয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে সংঘর্ষে জড়ায় তারা। 

নরসিংদী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) হারুনুর রশীদ বলেন, কেন্দ্রের বাইরে সামান্য সমস্যা থাকলেও ভোটকেন্দ্রের ভেতরে কোনো সমস্যা নেই। এখানে সুষ্ঠুভাবেই ভোট হচ্ছে।

তিন ইউনিয়নে ভোট বর্জন :  নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে সদর উপজেলার আমদিয়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী নাজিম উদ্দিন ভূঁইয়া রিপন, কাঁঠালিয়া ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. জহিরুল ইসলাম হিরন মোল্লা ও করিমপুর ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া ভোট বর্জন করেছেন। 

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তৃতীয় ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ৫৬৯ জন। তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ১০০, সংরক্ষিত আসনের সদস্য পদে ১৩২ ও সাধারণ সদস্য পদে ৩৩৭ জন বিনা ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ছাড়া এই ধাপের ভোটে লড়ছেন ৫০ হাজার ১৪৬ জন। চেয়ারম্যান পদে চার হাজার ৪০৯, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ১১ হাজার ১০৫ ও সাধারণ সদস্য পদে ৩৪ হাজার ৬৩২ জন প্রার্থী রয়েছেন।

এই ধাপের ভোটে কেন্দ্র ছিল ১০ হাজার ১৫৯টি, ভোটকক্ষ ৬১ হাজার ৮৩০টি। ভোটার সংখ্যা ২ কোটি এক লাখ ৪৯ হাজার ২৭। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে পুলিশ ও আনসারের ২২ জনের ফোর্স রাখা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ, আনসার, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স। এছাড়া মাঠে রয়েছেন পাঁচ শতাধিক বিচারিক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। 

ইতোমধ্যে দুই ধাপের ভোট সম্পন্ন হয়েছে। চতুর্থ ধাপে ৮৪০ ইউপিতে ২৬ ডিসেম্বর ও পঞ্চম ধাপে ৭০৭ ইউপিতে ৫ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ হবে।

আরএআর