কবি তার গল্প ও কবিতায় দেশ, মানুষ ও প্রকৃতির কথা তুলে ধরেন। আর চিত্রকররা রংতুলির খেলা করে ছবির মেলা করেন। আবার কেউ আছেন সেই কবি, চিত্রকর, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি ও জীবজন্তুর বিভিন্ন প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলেন নিপুণ হাতে। এমনই এক ভাস্কর্যশিল্পী হলেন ফকির আনোয়ার হোসেন।

ফকির আনোয়ার পেশায় একজন সেলুন-শ্রমিক। জয়পুরহাট-দিনাজপুর জেলা সীমানার শূন্যরেখায় অবস্থিত পাকা রাস্তার পাশে একটি জরাজীর্ণ খুপরিতে মানুষের চুল কেটে আয় করে কোনো রকম চালান। টানাপোড়েনের সংসার চালাতে গিয়ে সেলুনে কিনতে পারেননি কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি। তাই তেমন আয় করতে পারেন না। এ জন্য কাঠ, হাতুড়ি আর বাটালিকে সঙ্গী করেছেন তিনি। এগুলো দিয়েই কাঠের ওপর ফুটিয়ে তোলেন মানুষ, জীবজন্তুসহ বিভিন্ন প্রতিকৃতি।

আনোয়ার হোসেন দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর উপজেলার দক্ষিণ বাসুদেবপুর গ্রামের খাদেম আলী মুন্সির ছেলে। তিনি ছোটবেলা থেকেই বাউল গান শুনতে ও গাইতে ভালোবাসতেন। তাই তিনি কুষ্টিয়ায় লালন একাডেমির সদস্য হন। এ গ্রামেই তিনি তার মা, স্ত্রী-সন্তানসহ বসবাস করেন।

সরেজমিনে গেলে জানা যায়, প্রায় ১৪ থেকে ১৫ বছর ধরে আনোয়ার হোসেন কাঠ দিয়ে তৈরি করছেন নানা ভাস্কর্য। এর মধ্যে ভারতের মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, লালন শাহ, বাবা শেখ ফরিদসহ বিভিন্ন গুণী ব্যক্তি ও জীবজন্তুসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মনীষী ব্যক্তির বিভিন্ন প্রতিকৃতি। সেগুলো জয়পুরহাটের পাঁচবিবি ও দিনাজপুরের হাকিমপুর সীমান্তরেখায় অবস্থিত একটি খুপরি ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন।

আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি একজন নরসুন্দর (নাপিত)। এই কাজ করে তেমন আয়রোজগার করতে পারছি না। আমার নিজের ভেতরে চিন্তা আসে যে দেশের বিখ্যাত মানুষকে নিয়ে কিছু কাজ করব। এই কাজ করার জন্য প্রায় ১৪-১৫ বছর আগে কিছু গাছের গুঁড়ি জোগাড় করলাম। এরপর নিজ অভিজ্ঞতায় বিখ্যাত নানা মানুষের ভাস্কর্য বানাই।

তিনি আরও বলেন, এই কাজগুলো করতে আমার খুব ভালো লাগে। আমার হাতের এই কাজগুলো দেশবাসীর কাছে ছড়িয়ে দিতে চাই।

আনোয়ারের ছেলে রাশেদ ফকির বলেন, আমার বাবা নাপিতের কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম কাঠ দিয়ে বিভিন্ন মানুষের ভাস্কর্য তৈরি করেন। আমি ছেলে হিসেবে বাবাকে নিয়ে গর্ব করি।

আনোয়ারের স্ত্রী গুলসান আরা বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমার স্বামী সারাক্ষণ এই জিনিসগুলো তৈরি করতে ব্যস্ত থাকেন। চুল কেটে তেমন আয় করতে পারেন না। দিন গেলে ৫০ থেকে ১০০ টাকা দেয়। তা দিয়ে খুব কষ্টে আমাদের সংসার চলে।

জয়পুরহাট মৌনবাণী শিশু-কিশোর চারুকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক চিত্রকর মাহবুব আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করা আনোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করে যাচ্ছেন। আমি একজন চিত্রকর হিসেবে তার কর্মগুলো দেখলাম।

তিনি বিভিন্ন গুণীজনের ভাস্কর্য নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় করেছেন এবং অনবরত কাজগুলো করে যাচ্ছেন। আমি তার কাজে মুগ্ধ হয়েছি। তিনি আমাদের দেশের জন্য গর্ব এবং দৃষ্টান্তও হতে পারে। দেশে এমন মানুষ আমাদের অনেক বেশি বেশি প্রয়োজন।

চম্পক কুমার/এনএ