‘সুপার ফুড’ খ্যাত নীলাভ-সবুজ শৈবাল স্পিরুলিনায় দিন বদলের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রাজশাহীর তানোরের উদ্যোক্তা রাকিবুল সরকার পাপুল। বরেন্দ্রের লাল মাটিতে কৃত্রিম জলাধার তৈরি করে তিনি সমুদ্রের এই শৈবাল চাষে সফল হয়েছেন।

তার দেখাদেখি স্পিরুলিনা চাষে এগিয়ে আসছেন নতুন উদ্যোক্তারা। তবে মানুষের খাদ্যপণ্য হিসেবে বাজারজাতের আগে নিরাপদ ও টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন গবেষকরা।

গবেষকরা বলছেন, স্পিরুলিনায় মাছ ও গরুর মাংসের তুলনায় তিনগুণ এবং ডিমের তুলনায় ছয়গুণ বেশি প্রোটিন রয়েছে। মিনারেল রয়েছে সয়াবিনের তুলনায় দুইগুণ বেশি। আটার চেয়ে চারগুণ বেশি ফাইবারও রয়েছে। গাজরের তুলনায় পাঁচগুণ ও পালং শাকের তুলনায় ৪০ গুণ বেশি ক্যারোটিন রয়েছে। ক্যালসিয়াম রয়েছে দুধের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। এছাড়া পালং শাকের তুলনায় ৬৫ গুণ বেশি এবং গরুর মাংসের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি আয়রন রয়েছে স্পিরুলিনায়। ফলে স্পিরুলিনার বাণিজ্যিক চাষ পাল্টে দিতে পারে অর্থনীতির গতিধারা।

বিষয়টির প্রমাণও পেয়েছেন তানোর উপজেলার আমশো গ্রামের বাসিন্দা রাকিবুল সরকার। ১৭ হাজার লিটারের কৃত্রিম জলাধার থেকে এখন মাসে অন্তত লাখ টাকা আয় করছেন। বিনিয়োগের পাঁচ লাখ টাকা তুলেছেন প্রথম ছয় মাসেই। বছর ঘুরতেই দ্বিগুণ লাভের আশাও করছেন তিনি।

এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ শুরুর গল্প শুনিয়েছেন রাকিবুল সরকার। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্র বিজয়ের পর দেশে ব্লু ইকোনমির অপার সম্ভাবনার কথা বলতেন। ব্লু ইকোনমি সম্পর্কে জানতে গিয়েই তিনি স্পিরুলিনার সন্ধান পান। এরপর ইউটিউব ঘেঁটে জানতে পারেন ভারত, চীনসহ ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশেই এটির কৃত্রিম চাষ হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেন তিনিও স্পিরুলিনা চাষে নামবেন। এরপর ঝিনাইদহের কোটচাঁপুরের দেলোয়ার অ্যাগ্রো ফুড নামে একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন স্পিরুলিনা চাষ।

একসময় চাতাল ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন কলেজশিক্ষক রাকিবুল সরকার। সেই ব্যবসা এখন বন্ধ। আমশো মেডিকেল মোড়েই পরিত্যক্ত চাতালের এক পাশে স্পিরুলিনার জলাধার তৈরি করেছেন। এই বছরের ১ মার্চ প্রকল্পটি চালু হয়। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই আগ্রহী উদ্যোক্তারা আসছেন প্রকল্পটি পরিদর্শনে।

রাকিবুল সরকার জানান, তিনি ইট-সিমেন্টের ১৭ হাজার পানি ধারণক্ষমতার জলাধার তৈরি করেছেন। উপরে ছাউনি দিয়েছেন স্বচ্ছ প্লাস্টিকের টিন দিয়ে। যাতে সূর্যের আলো আসে সবসময়। চারপাশেও স্বচ্ছ পলিথিনের বেড়া ও নেট দেওয়া হয়েছে। খাদ্যপণ্য হওয়ায় সবসময় এটি নজরদারিতেই থাকে।

তিনি জানান, জলাধারটিতে সমুদ্রের পরিবেশ তৈরি করতে ৯ ধরনের রাসায়নিক মেশানো হয়েছে। বসানো হয়েছে অক্সিমিটার পাম্প। যাতে পানিতে অক্সিজেন এবং প্রবাহ দুটিই তৈরি হয়। শেষে মেশানো হয়েছে মাদার কালচার বা বীজ। সব মিলিয়ে প্রকল্পটিতে তার ব্যয় হয়েছে ৫ লাখ টাকা। পানির গুনাগুন বজায় রাখতে প্রতি ছয় মাস পর মেশাতে হয় রাসায়নিক। এই ব্যয় খুব বেশি নয়।

তিনি আরও জানান, স্পিরুলিনা আনুবীক্ষণিক শৈবাল। সপ্তাহে এক দিন এটি চিকন নেট দিয়ে ছেঁকে সংগ্রহ করতে হয়। সংগ্রহ করার পর প্রতি ১০ গ্রাম স্পিরুলিনার সঙ্গে এক গ্রাম লবণ মিশিয়ে শোধন করতে হয়। এরপর ড্রায়ার মেশিনে শুকিয়ে বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করতে হয়।

এটি দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প জানিয়ে রাকিবুল সরকার বলেন, তার এই প্রকল্প থেকে প্রতি মাসে ১৪-১৫ কেজি শুকনো স্পিরুলিনা পাওয়া যায়। রোদ বেশি থাকলে উৎপাদন বাড়ে। প্রতি কেজি শুকনো স্পিরুলিনা বিক্রি হয় সাড়ে ৩-৪ হাজার টাকায়।

তিনি জানান, ক্রেতাদের চাহিদা মতো নুডুলস অথবা গুড়া স্পিরুলিনা সরবরাহ করছেন। এছাড়া নর্দান এগ্রোর মোড়কে স্পিরুলিনা ক্যাপসুল ‘এন-লিনা’ তৈরি করে বাজারজাত শুরু করেছেন তিনি। অনলাইনে এমনকি সশরীরে এসে অনেকেই কিনে নিয়ে যান। খরচ বাদে প্রতি কেজিতে অন্তত ১ হাজার টাকা লাভ থাকে।

নতুনদের প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোগ শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন রাকিবুল সরকার। তিনি বলেন, কৃত্রিম জলাধারের পানিকে সমুদ্রের পানির মতো তৈরিতে বিভিন্ন রাসায়নিক মেশাতে হয়। কোন রাসায়নিকে কী পরিমাণ মেশাতে হবে এটি হাতেকলমে শেখা দরকার। তাছাড়া বাজারজাত নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে। অনেকেই বাজার না পেয়ে চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে উদ্যোগ শুরুর আগে বাজার যাচাই করা জরুরি।

এই উদ্যোগ প্রশংসনীয় বলে জানিয়েছেন দেশের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, খোলা জলাধারে স্পিরুলিনা চাষ পুরোনো উদ্যোগ। কিন্তু আমাদের দেশে এটি নতুন। নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ। স্পিরুলিনার ৮০ শতাংশ নানা ধরনের ভিটামিন রয়েছে। যা পরীক্ষিত।

এটি নতুন প্রযুক্তি না, সারা বিশ্বে স্পিরুলিনা ট্যাবলেট, ক্যাপসুল আকারে বিক্রি হয়ে থাকে। গবাদিপশু-লাইভস্টক ফিড তৈরিতে এটি ব্যবহার হয়। সেজন্য এখানে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে। তারা সফলতা দেখিয়েছে। এখন টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিত করতে গেলে এগুলো করতে হবে।

তিনি যোগ করেন, খোলা জলাধার নানাভাবে ‍দূষিত হতে পারে। বায়ুবাহিত নানা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক সেখানে প্রবেশ করতে পারে। স্পিরুলিনার সঙ্গে জন্মাতে পারে ক্ষতিকর ছত্রাক ও শৈবাল। যা দেখতে স্পিরুলিনার মতোই। এজন্য সহযোগী গবেষণাগার লাগবে।

সংগ্রহের সময় শুদ্ধিকরণে বিশেষ গুরুত্ব দেন এই গবেষক। তিনি বলেন, এগুলো করতে গেলে যে ধরনের শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া থাকা দরকার সেটি তাদের কাছে আছে কিনা তা নিয়ে আমরা সন্দিহান। সেখানে যেসব কর্মী কাজ করছেন, তারা কোন নিয়ম মানেন, নির্দিষ্ট পোশাক পরেন কিনা, ঠিকমতো তারা হাত ধৌত করেন কি না আমাদের জানা নেই। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করে স্পিরুলিনা উৎপাদন করা জরুরি।

স্পিরুলিনা বাজারজাতের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা মানার তাগিদ দেন অধ্যাপক ড. এম মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, স্পিরুলিনা বাজারজাতের আগে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। 

এসপি