জাকিয়া। বয়স ৯ বছর। বাড়ি মধুপুর গড়ের চুনিয়া প্লটপাড়ায়। বাবা মারা যাওয়ার পর মা অন্যত্র বিয়ে করেছেন। ফলে পিতৃহীন জাকিয়ার ঠাঁই হয় দাদির কাছে। দাদির ছায়ায় বড় হচ্ছে সে। এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। এখানে সে বিনা বেতনে লেখাপড়া করছে। শুধু জাকিয়া নয়, তার মতো শতাধিক শিক্ষার্থী টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার বেরীবাইদ ইউনিয়নের দক্ষিণ জাঙ্গালিয়ায় বনের ভেতর স্থাপিত আলোর ভূবন আর্দশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে লেখাপড়া করছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ জায়গাজুড়ে মধুপুর গড়ের ভেতর দক্ষিণ জাঙ্গালিয়ার আনন্দপাড়া বাজার সংলগ্ন এলাকায় মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠেছে আলোর ভূবন আদর্শ বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয়ের মাঠে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করছে। দুটি টিন শেডের ঘরে রয়েছে তিনটি করে কক্ষ। একটি কক্ষে রয়েছে লাইব্রেরি। ঘরের মেঝে কাঁচা ও কক্ষগুলোর মাঝে কোনো দেয়াল নেই। নেই ঘরের দরজা ও জানালা। খাবার পানির জন্য টিউবওয়েলসহ নেই পায়খানার ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ সংযোগও নেই সেখানে। তারপরও আশপাশের চারটি গ্রামের শতাধিক শিক্ষার্থী এই বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। এখানে পড়াশুনা শেষ করে অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজে পড়াশুনা করছেন। অনেকেই আবার চাকরি করছেন। কিন্তু বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার নিজ উদ্যোগে করা বিদ্যালয়টি সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো সাহায্য সহযোগিতা না পেয়ে বন্ধ হওয়ার পথে।

জানা গেছে, উপজেলার দক্ষিণ জাঙ্গালিয়ার আনন্দপাড়া বাজার সংলগ্ন এলাকায় ৬০ শতাংশ জায়গা নিয়ে ২০০৮ সালে অবৈতনিক আলোর ভূবন আর্দশ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন জাহাঙ্গীর কবির নামে এক যুবক। তখন থেকেই জাহাঙ্গীরকে সহায়তা করেছেন আরও দুই যুবক। আশপাশের চারটি গ্রামের শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বিদ্যালয়টির। জাহাঙ্গীর তার নিজের বেতনের টাকার অর্ধেক দিয়ে এবং বিভিন্ন ব্যক্তির দান সহায়তায় বিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একজনসহ চারজন শিক্ষক রয়েছে বিদ্যালয়টিতে। তবে মহামারি করোনাভাইরাসে বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যালয়টি। 

করোনার পর বিদ্যালয় খোলা হলেও কোনো সহায়তা না পাওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়ে সেটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর কবির ‘১০০ জন ছাত্রছাত্রীসহ একটি স্কুল বিক্রি হবে’ এমন শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস দেন।

বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জাকিয়া খাতুন জানায়, বাবা মারা যাওয়ার পর মা অন্যত্র বিয়ে করে সেখানে সংসার করছে। দাদি আমাকে লালন-পালন করছেন। এই স্কুল ছাড়া দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যে আর কোনো প্রাথমিক স্কুল নেই। এখানে পড়তে কোনো টাকা লাগে না। স্যার-ম্যাডামরা অনেক সুন্দরভাবে আমাদের পড়ান। পড়াশুনা করে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই।

পঞ্চম শ্রেণির ফারজানা জানায়, বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে আমারদের পড়াশুনাও বন্ধ হয়ে যাবে। দূরে গিয়ে পড়া সম্ভব হবে না। আমরা গরিব মানুষ, তাই টাকা-পয়সা দিয়ে পড়াশুনা করা সম্ভব না।

অভিভাবকরা জানায়, বিদ্যালয়টি এখানে স্থাপিত না হলে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ত। এই গ্রামের অধিকাংশ পরিবার হতদরিদ্র দিনমজুর। তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালানো খুবই কঠিন। এখানে তাদের পড়াশুনা করতে কোনো টাকা খরচ হয় না।

আলোর ভূবন আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোশী চাম্বুগং বলেন, দক্ষিণ জাঙ্গালিয়ার আশপাশে দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এখানকার প্রায় ৮০ শতাংশ পরিবার অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ফলে এখানে শিক্ষার হার খুবই কম। অধিকাংশ মানুষ দিনমজুর হওয়ার তাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনায় তেমন আগ্রহী নয়। ফলে এলাকায় বাল্যবিয়ের হার বেশি। পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, জাহাঙ্গীর কবির এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। সঙ্গে আরও কয়েকজন যুবক মিলে বিদ্যালয়টি চালু করেন। এখানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নেওয়া হয় না। শুধু পাঠ্যবই ছাড়া সরকারিভাবে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি। এর মধ্যে করোনার কারণে বিদ্যালয়টি বন্ধ ছিল দীর্ঘ দিন। এখন অর্থের অভাবে বিদ্যালয়টি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

৩ নং রেবীবাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জুলহাস উদ্দিন বলেন, বিদ্যালয়টি সরকারি বা বেসরকারিভাবে রেজিস্ট্রেশন না থাকায় পরিষদ থেকে কোনো প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ওই বিদ্যালয়ের আশপাশে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এখানে শিক্ষার হার খুবই কম। ইউনিয়নের মানুষ অধিকাংশ দিনমজুর। জাহাঙ্গীর নামে এক যুবক বিদ্যালয়টি পরিচালনা করছে। টাকার অভাবে বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায়েই ঝরে পড়বে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি আহ্বান এলাকার মানুষের স্বার্থে এবং কোমলমতি শিশুদের কথা বিবেচনা করে বিদ্যায়লটি ভালোভাবে পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া হোক।

জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি বলেন, সরকার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে এবং দেড় হাজার মানুষের জন্য একটি করে প্রাইমারি বিদ্যালয় রাখার ব্যবস্থা রেখেছে। মধুপুর গড় অঞ্চলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টি যাতে সরকারের স্বীকৃতি পায় এবং সরকারি সহায়তা পায় সেজন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনের সংসদ সদস্যের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

এসপি