ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে চার শিক্ষার্থী এলেন শেফালীর চা দোকানে। তারা বলছেন, কাকি, ভালো করে চারটা দুধ-চা দিন। একগাল হেসে শেফালী তাদের বসতে বললেন ভেতরে। এ সময় আশপাশে আরও কয়েকজন অর্ডার দিয়ে চায়ের কাপে তাকিয়ে অপেক্ষায় আছেন। কাপগুলো গরম পানিতে ধুয়ে সাজিয়ে প্রথমে তাতে দিলেন চিনি, ঢাললেন গরুর দুধ, শেষে চায়ের লিকার।

তারপর দু-আঙুলের মাঝে বশ করে রাখা চামচ নাড়তে নাড়তে শেফালীর চায়ের কাপ হয়ে ওঠে ফেনাময় টইটম্বুর। চামচটা রেখে প্রতিটি কাপে তুলে দেন দুধের সর। অপেক্ষায় থাকা ক্রেতাদের হাতে তুলে দেন চায়ের কাপ। তাতে চুমুক দিয়ে এক অমৃতের স্বাদ নেন তারা। চায়ে চুমুক দিয়ে শিক্ষার্থীরা একে অন্যের সঙ্গে বলাবলি করছেন, দোস্ত, দারুণ হয়েছে!

জানতে চাইলে কলেজশিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাকির হাতের চায়ে অনেক স্বাদ পাওয়া যায়। তার হাতে বানানো চা পান করার জন্য প্রতিদিনই আমরা এখানে চলে আসি। সমস্বরে তার সহপাঠীরাও বললেন, এখানের চা পান করে তৃপ্তি নিয়ে ফিরে যাই, তাই আসি। যাওয়ার সময় তারা শেফালীকে ধন্যবাদ দিয়ে আবার আসব বলে যান।

শুধু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীই নন, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও শিক্ষিত লোকেরাও তার দোকানে নিয়মিত চায়ের টেবিলে আড্ডা জমান। আর পরিচিত হওয়ার কারণে দূরদূরান্ত থেকে শেফালীর চা পান করতে ছুটে আসেন চা-প্রেমীরা। এ জন্য সবাই তার দোকানের নাম রাখেন ‘কাকির চায়ের দোকান’।

শেফালী বেগম যশোর শহরের ধর্মতলা রেলক্রসিং এলাকার চা বিক্রেতা খাইরুল ইসলামের স্ত্রী। নিজস্ব জমিজমা না থাকায় রেললাইনের পাশে সরকারি জমির ওপরে একটি খুপরিতে বসবাস করেন।

প্রায় ১৫ বছর আগে তার জীবন এমন সুন্দর ছিল না। হঠাৎ নেমে আসে এক চরম অনিশ্চয়তা। স্বামী খাইরুল ইসলাম লিভার ও চর্মরোগসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তখন এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে অভাবে পড়েন শেফালী। এরই মধ্যে স্বামীর চিকিৎসার খরচ জোগাতে আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেন। অভাব আও জেঁকে বসে ঘাড়ে।

সংসারে উপার্জনক্ষম আর কেউ না থাকায় ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাতে থাকা স্বামীর পুরোনো চায়ের দোকানটা মেরামত করেন। উপায়ান্তর না পেয়ে এখানেই নতুন করে শুরু করেন চা বিক্রি। দোকানটি প্রধান সড়কের পাশে হওয়ায় এবং চায়ের স্বাদ আকর্ষণীয় হওয়ায় অল্প দিনেই পরিচিতি পান শেফালী।

কেন আপনার চা এত জনপ্রিয়, জানতে চাইলে শেফালী ঢাকা পোস্টকে জানান, প্রথমে রং চা বানালেও ক্রেতাদের চাহিদা থাকায় শুরু করেন স্পেশাল দুধের চা বিক্রি। এতে ক্রেতারা খুশি হলে নিয়মিত করেন। তারপর জনপ্রিয়তা বাড়ে শেফালীর চায়ের দোকানের। বাসস্ট্যান্ড এলাকা, আশপাশে সরকারি অফিসগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একটু অবসরে চলে আসেন শেফালীর চায়ের দোকানে।

তবে এর মধ্যে বাধাও এসেছে অনেক। যশোর ঝিনাইদহ চার লেন সংস্কারে ফুটপাত দখলমুক্ত করায় বিপাকে পড়েন তিনি। কিন্তু স্থানীয়দের সহযোগিতায় ৫০ গজ দূরে একটি মার্কেটে দোকান নেন শেফালী। এখন সেখানেই আবার নতুন উদ্যমে বিক্রি করছেন স্বাদে ভরপুর দুধ চা ও রং চা।

শেফালী বলেন, প্রতিদিন সকাল ৯টায় দিকে দোকান খুলি, আর বন্ধ করি রাত ১২টার দিকে। ১৬ ঘণ্টা ধরে চলে চা বানানো। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটু বেচাকেনা কম হয়। তবে বিকেল থেকে রাত যত গভীর হয়, ততই চায়ের দোকানে ভিড় জমতে থাকে। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বয়স্ক, সব শ্রেণির মানুষ এখানে চলে আসে। আমি রং চা ৫ টাকা আর দুধ চা ২০ টাকায় বেচি।

লাভের হিসাব বিষয়ে জানান, প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ কেজি গরুর দুধের চা বিক্রি করেন তিনি। কাপ হিসাবে দাঁড়ায় ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০। দিনে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বেচাবিক্রি হয় তার দোকানে। এর মধ্যে খরচ বাবদ চলে যায় দুই-তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ মাসে থাকে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এতেই খুশি শেফালী।

কী পরিবর্তন এনেছেন সংসারে, জানতে চাইলে শেফালী বলেন, চা বিক্রির উপার্জনেই দুই সন্তানকে বড় করেছি। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছি। মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে এখন সুখে আছে। তবে আক্ষেপ করে জানান, একমাত্র ছেলেটাকে বড় করলেও অসুস্থ বাবা ও পরিশ্রমী মাকে দেখে না। তারপরও তপ্ত আগুনে ঘর্মাক্ত চেহারায় হেসে বলেন, চায়ের এই ব্যবসায় এখন তার মনে শান্তি, আগের চেয়ে লাভও বেশি। ভালোই আছি।

শেফালীর অসুস্থ স্বামী খাইরুল বলেন, আমি অসুস্থ হওয়ার পর শেফালী অনেক কষ্ট করেছে। আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে আমার সংসারের হাল ধরেছে। একজন নারী হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং পুরো পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া খুব কঠিন কাজ। শেফালীকে দেখে সত্যিই আমার গর্ব হয়।

শেফালীর পাশের মুদি দোকানি সবুজ হোসেন বলেন, স্বামী অসুস্থ হলে সংসারের হাল ধরেন শেফালী। নারী হয়েও একজন পুরুষের চেয়ে সফল তিনি। কিন্তু প্রথমে তাকে শুনতে হয়েছে নানা কটু কথা। সেসব উপেক্ষা করেই চা বিক্রিতে তিনি সংসারের হাল ধরেছেন। একসময় যারা কটু কথা বলতে ছাড়েননি, তারাও এখন শেফালীর প্রশংসা করেন এবং চা খেতে আসেন।

এনএ