উপকূলীয় অঞ্চলে পাল্টে গেছে মানচিত্র
খোলপেটুয়া নদীর তীর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের গ্রাম প্রতাপনগর। দুই মাস আগেও এলাকাটি ছিল জনপদ। যে জনপদে ছিল ঘরবাড়িসহ জনবসতি। তবে ভাঙনের কবলে পড়ে জনবসতি এখন পরিণত হয়েছে নদীর সংযোগ খালে। তাই জনপদের ভূমির পরিমাণ কমে নদীর সীমানা বেড়েছে।
ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা বলছেন, উপকূলীয় এলাকায় মানচিত্র বদলে গেছে, দেয়াড়া জরিপ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে, ভূগোল ও পরিবেশবিদরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব এলাকা বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যার নমুনা ইতোমধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের প্রতাপনগর গ্রামটি এখন খোলপেটুয়া নদীর সংযোগ খাল। নদীর বেড়িবাঁধ থেকে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কৃষিজমি, মাছের ঘের ও জনবসতি বিলীন হয়ে গেছে। নদীর সঙ্গে মিশে গেছে উপকূলীয় এ এলাকার বিস্তীর্ণ জনপদ।
প্রতাপনগর গ্রামের বাসিন্দা মৃত ইসহাক হাওলাদারে ছেলে শামসুর রহমান হাওলাদার। হাওলাদার বাড়ি বায়তুন নাজাত জামে মসজিদের মোয়াজ্জেম তিনি। ঘরবাড়ি হারিয়ে এখন রাস্তায় খুপরিতে বসবাস করছেন শামসুর রহমান। তিনি জানান, এখন নদীর সীমানা যেখানে চলে এসেছে, আগে সেই নদী ছিল এক কিলোমিটার দূরে। নদীভাঙনে জমি-জায়গা সব চলে যাচ্ছে। আগের মানচিত্রের সঙ্গে এখনকার মানচিত্রের মিল নেই। জোয়ারের পানিতে জনপদের জমি, ঘরবাড়ি, মাছের ঘের বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের হরিসখালী গ্রামের হায়দার আলী বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে আমরা সব হারিয়ে খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। চারপাশে নদীতে পরিণত হয়েছে। কেউ চলে গেছে ঘরবাড়ি ফেলে রেখে, কারও ঘরবাড়ি চলে গেছে নদীর মধ্যে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ারও পরিস্থিতি নেই। এখানে পড়ে আছি কোনো রকম।
প্রতাপনগর গ্রামের বাসিন্দা মাসুম বিল্লাহ জানান, বারবার বেড়িবাঁধ ভাঙার ফলে এলাকার মানচিত্রের যে সীমারেখা, সেটা বিলুপ্তির পথে। ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রের সঙ্গে বর্তমান চিত্র মেলে না। ব্রিটিশ আমলের সেই সীমারেখা এখন হারিয়ে গেছে। চাকলা, প্রতাপনগর, কুড়িকাওনিয়া, শ্রীপুর— এ কয়েকটি উপকূলীয় গ্রামের মানচিত্রের সীমারেখা একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, পরিবর্তন ঘটেছে। এ অবস্থার অনুকূল পরিবেশ যদি চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যতে প্রতাপনগর ইউনিয়নটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে নদীগর্ভে বিলীন হবে।
ওই এলাকার বাসিন্দা সাঈদুর রহমান বলেন, দিন দিন ফসলি জমিগুলো বিলীন হয়ে জমির মধ্যে দিয়ে নতুন নতুন খালের সৃষ্টি হচ্ছে। এখন সেখানে নৌকা চলছে, সেটি তিন মাস আগেও ছিল জনপদ। এসব স্থানে মানুষের বসতি ছিল। দৈনিক কোনো না কোনো মানুষ গৃহহীন হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। কেউ উঁচু স্থানে টংঘর বানিয়ে বসবাস করছে। কর্মসংস্থানের যে ব্যবস্থা ছিল, তা এখন একেবারেই নেই। এতে অভাব তীব্র আকার ধারণ করছে।
প্রতাপনগর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) দেবদাস কুমার ঘোষ বলেন, ভূমির চিত্র পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটা জরিপ কার্যক্রম চালিয়ে দেখব কতটুকু জমি নদীগর্ভে চলে গেল। প্রতিবছরই অব্যাহত নদীভাঙনের ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। একটু স্বাভাবিক হলে বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা চিঠি দেব।
তিনি বলেন, আমি মনে করি ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে নদীভাঙনের কবলে পড়ে উপকূলীয় এলাকায় মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। এটা নিয়ে দেয়াড়া জরিপ কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। কেননা আগের মানচিত্রের সঙ্গে এখনকার বাস্তব চিত্রের মিল নেই।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আ ন ম গাউছার রেজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও সমুদ্র সমতলের পানির উচ্চতা বেড়েছে। এগুলোর ফলে আমাদের দেশের বর্তমান যে মানচিত্র, সেটির একটা বড় পরিবর্তন হবে।
তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা সমস্যাসংকুল দ্বীপ ছিল দক্ষিণ তালপট্টি ও পূর্বাশা দীপ। সেটি ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে সমুদ্রতলে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক জনপদ হারিয়ে যাবে। যার প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে উপকূলীয় বিভিন্ন অঞ্চলে।
এনএ