তালাবদ্ধ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মাঠে প্রসূতির সন্তান প্রসব
রাত তখন সোয়া দশটা। গর্ভবতী লিমা বেগমের হঠাৎ প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়। কাতরাতে থাকেন তিনি। তখনও বাড়িতে চলছিল ডেলিভারির চেষ্টা। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে নিরাপদ ডেলিভারির আশায় ছুটে আসেন মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে। অটোরিকশাতে করে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা পর নয় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসা লিমার চোখেমুখে তখন হতাশার ছাপ।
দিনমজুর স্বামী শাহাদত হোসেন ছোটাছুটি করতে থাকেন মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের সামনে। সেবাকেন্দ্রে কেউ নেই। দরজায় তখন তালা ঝুলছিল। অথচ ভেতরে সাটানো ব্যানারে লেখা রয়েছে ‘আর কোনো ভাবনা নয় নরমাল ডেলিভারি সব সময়, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র সপ্তাহের ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা আছে আপনার পাশে।’
বিজ্ঞাপন
এভাবেই ছোটাছুটি করতে করতে লিমার প্রসব ব্যথা আরো বেড়ে যায়। ঘড়ির কাটায় তখন রাত পৌনে ১২টা। উপায় না পেয়ে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে তাকে ওই সেবা কেন্দ্রের পাশে থাকা নলকূপের কাছে নেন তার শাশুড়িসহ অন্যরা। কিছুক্ষণ পর লিমার প্রসব যন্ত্রণার চিৎকার থেকে ভেসে আসে নবজাতক শিশুর কান্নার আওয়াজ। কোনো স্বাস্থ্যকর্মী ও গাইনী ছাড়াই সন্তান প্রসবের পর আর দেরি না করেই বাড়ি ফিরে যান ওই দম্পতি।
সেবা না পাওয়ার এ ঘটনাটি ঘটেছে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে। গতকাল মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) রাতে ওই কেন্দ্র তালাবদ্ধ থাকায় বাইরে খোলা মাঠেই কন্যাশিশু প্রসব করেন লিমা বেগম। তাদের বাড়ি হারাগাছ পৌর এলাকায় নয় নম্বর ওয়ার্ডের চর নাজিরদহ গ্রামে।
ঘটনার রাতে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের কাছেই ছিলেন স্থানীয় সংবাদকর্মী মেহেদী হাসান সুমন। তিনি ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদককে মেহেদী হাসান সুমন বলেন, আগে সেখানে ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দেওয়া হতো। কিন্তু গত সাত-আটদিন ধরে সেবাকেন্দ্রটি রাতের বেলা করে বন্ধ থাকছে। এ কারণে প্রসব ব্যথা নিয়ে আসা লিমা বেগম কোনো সেবা পায়নি। বরং ঝুঁকি নিয়েই কেন্দ্রের পাশে থাকা একটি নলকূপের কাছে সন্তান প্রসব করেন ওই গর্ভবতী। প্রয়োজনের সময় কোনো স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও গাইনী
উপস্থিত না থাকার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।
এদিকে সন্তান প্রসবের পর মা ও নবজাতক শিশু সুস্থ রয়েছেন বলে জানান লিমার স্বামী শাহাদত হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি দিনমজুরি করে সংসার চালাই। তেমন আয় রোজগার নেই। এ কারণে বউকে শহরের হাসপাতালে নিতে পারিনি। ভেবেছিলাম বাড়িতে যখন ডেলিভারি হচ্ছে না, তাই মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে কেন্দ্র বন্ধ থাকায় কাউকে পাইনি। অনেক কষ্টে আমার বউ, বাচ্চা প্রসব করেছে। তখন আমরা ভীষণ ভয়ে ছিলাম। আল্লাহর রহমতে গর্ভধারণের ৯ মাস ১০ দিনের মাথায় আমার বউ, বাচ্চা প্রসব করেছে। এখন মা ও মেয়ে দুজনেই ভালো আছে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গরিবের সেবার জন্যই ওই মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। কিন্তু বিপদের সময়ে যদি ডাক্তার না থাকে তাহলে হাসপাতাল থেকে লাভ কী? আমার বউয়ের হয়তো বিপদ হয়নি। অন্যদের যে এমন ঘটনায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না, তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। নরমাল ডেলিভারির জন্য এসব সেবাকেন্দ্র সারাক্ষণই খোলা রাখা উচিত। যাতে মানুষ যে কোনো সময় গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে পারে।
এদিকে রাতে সেবাকেন্দ্রটি তালাবদ্ধ থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন হারাগাছ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা মোছা. জান্নাতুল ফেরদৌসী। মুঠোফোনে আলাপকালে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, নরমাল ডেলিভারি করাতে আমরা ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস অব্যাহত রেখেছিলাম। তখন একটা প্রজেক্ট ছিল। এখন সেই প্রজেক্ট নেই। তাছাড়া এই কেন্দ্রে রাতে ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। আমাদের জনবলও কম। এ কারণে কিছুদিন ধরে রাতে কেন্দ্রটি বন্ধ রাখা হচ্ছে। তবে প্রতিদিনই সকাল থেকে আট ঘণ্টা সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দিতে আমরাও চাই। কিন্তু জনবল না বাড়ানো পর্যন্ত সেটা সম্ভব হবে না। আগে যেখানে ৫ জন কর্মী ছিল, এখন তা ৩ জনে দাঁড়িয়েছে। দুজন ধাত্রী ও আমি নিজে ছাড়া আর কোনো স্টাফ নেই। রাত হলে বিভিন্ন ধরনের মানুষ এসে নানানভাবে আমাদের বিরক্ত করার চেষ্টা করে। রাত হলে ধাত্রীরা এখানে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে থাকেন।
এ ব্যাপারে কাউনিয়া উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএএস