মানুষের জন্মপরিচয় তেমন গুরুত্ব বহন করে না। কর্ম ও অবদানের মাধ্যমে মানুষ পায় মর্যাদার আসন, হয় স্মরণীয়-বরণীয়। আর সেই সফলতার পেছনে অদম্য মানসিকতাই থাকে মূল অনুঘটক। যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে দূর করার জন্য সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। শারীরিক প্রতিবন্ধিতার পরও জীবনসংগ্রামে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন অনেকে।

তেমনই একজন মানুষ মামুন মিয়া। দুটি হাত ও পা স্বাভাবিক নেই তার। চলাফেরা ও কাজ করতে পারেন না। তারপরও নানা বাধা-বিপত্তি আর সমাজের সংকীর্ণ দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে তিনি আজ সফল উদ্যোক্তা। স্থানীয় বাজারে মোবাইল সার্ভিসিং, ফ্লেক্সিলোড ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসা করে ভালো আছেন তিনি।

কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার মধ্য নারান্দী গ্রামে বাড়ি মামুন মিয়ার। তার বাবা মৃত আবদুল কাদের। পরিবারে তার মা, তিন ভাই ও তিন বোন আছে। তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইবোনদের মধ্যে মামুন তৃতীয়।

ব্যবসা শুরু করার পর স্থানীয় একটি গ্রামের আয়শার সঙ্গে পরিচয় হয় মামুনের। পরে দুজন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। তাদের পরিবার উদ্যোগ নিয়ে বিয়ে দেন দুজনকে। বিয়ের এক বছর পরই তাদের কোলজুড়ে আসে মেয়ে মাইশা। তার দুই বছর পর জন্ম হয় ছেলে আবুল হাসানের। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মাইশা ও আবুল হাসানও হয় বাবার মতো শারীরিক প্রতিবন্ধী।

জানা যায়, ১৯৯০ সালের ৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন মামুন। জন্মের পর থেকেই প্রতিবন্ধিতা শুরু হয় তার। দুই হাত ও দুই পা অচল হতে শুরু করে। তখন উন্নত চিকিৎসা করানোর জন্য তার পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। কিছুদিন পরই মামুন তার বাবাকে হারান। তারপর সংসারে অভাব শুরু হয়। বড় ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ির সামনে একটি টং-দোকান দেন মামুন। বাজার থেকে চিপস, চকলেটসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এনে বিক্রি করা শুরু করেন।

কিন্তু মামুন তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। আত্মীয়, পরিবার-পরিজনসহ সবার কাছে পেয়েছেন ভালোবাসা। তবে কেউ কেউ আবার বাঁকা চোখেও দেখেছেন। কিন্তু কোনো কিছুকে পাত্তা না দিয়ে মামুন ছুটে চলেছেন আপন মহিমায়।

একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন ইলেকট্রিক ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখবেন। কাজ শেখা হলে স্থানীয় আমরিতলা বাজারে একটি দোকান ভাড়া করে শুরু করেন নতুন যাত্রা। আস্তে আস্তে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন মামুন। বর্তমানে সার্ভিসিংয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির সেবা ও মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছেন তিনি।

চলাফেরা করার জন্য সৌরবিদ্যুৎ চালিত একটি বিশেষ গাড়ি ব্যবহার করেন মামুন। যেটা দিয়ে বাজার থেকে বাড়িতে ও বিভিন্ন স্থানে চলাফেরা করেন। একা একা গাড়িতে ওঠা-নামা করলেও দোকান অন্য কেউ খুলে দেন। দোকানের ক্যাশে ওঠার জন্য তৈরি করেছেন একটি কাঠের সিঁড়ি। কোনোরকমে সিঁড়িতে ভর করে ওঠেন চৌকিতে। মাঝেমধ্যে দোকানে উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ব্যথাও পেয়েছেন।

মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে পারলেও আমার চিন্তা আমার দুটি সন্তান নিয়ে। আমার জীবনে তো শেষ আছে। আমার মতো আমার দুটি সন্তানও প্রতিবন্ধী। ডাক্তার বলেছে ছেলেকে চিকিৎসা করালে সুস্থ হবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করি, আমার সন্তান দুটির উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলে আমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না।

মামুনের স্ত্রী আয়শা আক্তার বলেন, আমার নিজের ইচ্ছাতেই আমি মামুনকে বিয়ে করেছি। আমার কোনো কষ্ট নেই। কারণ তিনি সুস্থ মানুষের মতোই রোজগার করেন। তবে আমার দুটি সন্তান নিয়ে আমি খুব কষ্টে আছি। তাদের যদি একটু চিকিৎসা করাতে পারতাম তাহলে ভালো হতো।

মামুনের মা রাহেনা খাতুন বলেন, আমার ছেলে অনেক কষ্ট করে জীবন চালাচ্ছে। এভাবেই জীবন চলে যাবে। কিন্তু আমার দুটি নাতি-নাতনির জন্য কষ্ট হয়। ঢাকায় নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছি। ডাক্তার বলেছে, চিকিৎসা করালে ভালো হবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটু সাহযোগিতা চাই।

প্রতিবেশী বাবলু আহমেদ, রিপন মিয়া, নাজমুল ইসলাম ও সুমন মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ছোট থেকেই দেখে আসছি মামুন শারীরিক প্রতিবন্ধী। মামুন মানুষের কাছে হাত না পেতে প্রথমে বাড়ির সামনে মুদির দোকান দিয়ে কাজ শুরু করে। এই উদ্যোগ আমাদের আনন্দ দিয়েছে। কারণ, অস্বাভাবিক হয়েও সে বসে না থাকার মানসিকতা দেখিয়েছে।

তারা বলেন, মামুনের কাছে মোবাইলের যেকোনো সমস্যা নিয়ে গেলে সমাধান হয়। অনেক সময় মামুনকে রাতে ফোন করেও মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড নিই আমরা। সে কিছুই মনে করে না। আমরা সমাজের হৃদয়বান মানুষ ও রাষ্ট্রের কাছে মামুনের দুটি সন্তানের চিকিৎসা সহায়তার জন্য আবেদন জানাই।

নারান্দী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. শফিুকল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামুন নিজের অবস্থান থেকে পরিশ্রম করে লড়ে যাচ্ছে। এটা ভালো উদাহরণ অন্যদের জন্য। ইউনিয়ন পরিষদে যখন যে সুযোগ-সুবিধা আসে সেগুলো আমরা তাকে দিই। প্রতিবন্ধী ভাতা ও তার স্ত্রীর মাতৃত্বকালীন ভাতা দিয়েছি। মামুনের যেকোনো প্রয়োজনে আমরা পাশে ছিলাম এবং থাকব।

তবে আমি সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানাই, তারা যেন মামুনের পাশে দাঁড়ান; যাতে তার দুটি সন্তানের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়।

এনএ/জেএস