রোগ-শোকে আক্রান্ত হলে মানুষ হাসপাতালে ছুটে যায়। রোগমুক্তির জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে সব ধরনের চেষ্টা করে। এখন হাসপাতালই যদি আক্রান্ত হয় ব্যাধিতে তাহলে রোগীর অবস্থা কেমন হবে?

সাভারের আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুৎ সংলগ্ন এলাকার মমতাজ উদ্দিন হাসপাতাল অনেকটা এমনই; নিজেই ব্যাধিতে আক্রান্ত। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক-নার্স, আছে উল্টো অনিয়ম আর হয়রানি। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালটি পরিচালিত হচ্ছে শুধু একজন এমবিবিএস ডাক্তার দিয়ে। আর ডাক্তার না হয়েও এক ব্যক্তি সেখানে রোগী দেখছেন নিয়মিত। করছেন আল্ট্রাসনোগ্রাফির মতো জটিল রোগ নির্ণয় পরীক্ষা। ব্যবহার করছেন বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন নাম্বার সম্বলিত এক ডাক্তারের নাম, প্যাড ও সিল!

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিবারাত্রি খোলা মমতাজ উদ্দিন হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাম, রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা, ইসিজি, এক্সরেসহ রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা করানো হয়। দিনের বেলা একজন মাত্র ডাক্তার থাকলেও রাতের বেলা এসব কাজ সম্পন্ন করেন একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট।

অনুসন্ধানে গেলে ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কামরুজ্জামান নামে এক রোগীর দেখা মেলে। গত ১৭ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে পেটে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে গেলে তাকে চেম্বারে বসা মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট আম্বার খান পাপ্পুর কাছে পাঠানো হয়। পাপ্পু ডাক্তার সেজে ৩০০ টাকা ভিজিটের বিনিময়ে কামরুজ্জামানকে দেখেন। পেট ব্যথার কারণ জানতে আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে হবে বলে জানান। 

ডাক্তারের কথা অনুযায়ী রোগী চলে যান হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমে। সেখানেও ডাক্তার রূপে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট আম্বার খান পাপ্পু! দিলেন রিপোর্ট ও ওষুধের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন)। কিন্তু প্রেসক্রিপশনে রয়েছে সিলসহ ডাক্তার শামসুল আরেফিনের নাম।

সন্দেহ হলে কামরুজ্জামান চিকিৎসকের পরিচয় এবং কোন মেডিকেল থেকে পাস করেছেন তা জানতে চান। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি আম্বার খান পাপ্পু। এতে কামরুজ্জামানের সন্দেহ আরও গাঢ় হয়। তিনি বিষয়টি স্থানীয় কয়েকজনকে জানান। 

বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ওই হাসপাতালে যায় ঢাকা পোস্ট। নিজেকে ডা. শামছুল আরেফিন পরিচয় দেওয়া আম্বার খান পাপ্পুর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি এই প্রতিবেদককেও প্রথমে ডাক্তার শামসুল আরেফিন নামে পরিচয় দেন। কিন্তু বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন নম্বর ওয়েবসাইটে সার্চ করলে আম্বার খানের সাথে ওয়েব সাইটে থাকা চিকিৎসকের ছবির কোনো মিল পাওয়া যায় না। পরে তিনি ভুল স্বীকার করে বলেন, ডাক্তার শামসুল আরেফিনের সিল-স্বাক্ষর ব্যবহার করার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি!  

তিনি কমিউনিটি হেলথ অ্যাসিসট্যান্ট বলে দাবি করেন। রাতে কোনো চিকিৎসক না থাকায় ডাক্তার পরিচয়ে রোগী দেখেন। পাপ্পু বলেন, ‘কিন্তু আমাকে রোগী দেখতে এবং আলট্রা করার নির্দেশনা দিয়েছেন হাসপাতালের ম্যানেজার সাদেকুল।’

হাসপাতালের ম্যানেজার সাদেকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। আম্বার খান নিজেই এই কাজ করেছেন। তাকে কর্তৃপক্ষ শাস্তি দেবেন। তিনি বলেন, হাসপাতালে রোগী তেমন নেই। এছাড়া হাসপাতালের আয় কম হওয়ায় রাতের ডিউটিতে ডাক্তার রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে মমতাজ উদ্দিন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবেল হোসেন বলেন, বিষয়টি জানার পরপরই আম্বার খানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

রুবেল হোসেন এই প্রতিবেদন না করার অনুরোধ করেন।

ভুক্তভোগী রোগী কামরুজ্জামান বলেন, ডাক্তার না হয়েও তিনি ডাক্তারের পুরো ভিজিট নিয়েছেন। এভাবে ডাক্তার না হয়েও চিকিৎসা দেওয়া কীভাবে সম্ভব! এমন নামধারী ডাক্তারদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা দরকার।

বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশনধারী ডাক্তার শামছুল আরেফিনের সাথে যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট।  তিনি বলেন, আমি এখন খুলনায় আছি। অনেক বছর আগে আমি মমতাজ উদ্দিন হাসপাতালে ডিউটি ডাক্তার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। আমার সময়ে ওই পাপ্পু ওয়ার্ড বয় হিসেবে কাজ করত। আমার নাম এখনো তারা ব্যবহার করছে, আমার জানা ছিল না।

সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সায়েমুল হুদা বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে হাসপাতালের ম্যানেজারকে সব কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে বলেছি। দ্রুতই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য, মমতাজ উদ্দিন জেনারেল হাসপাতালে বিভিন্ন অনিয়মসহ চিকিৎসায় অবেহলায় রোগী মৃত্যুর ঘটনায় ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। তখন হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন এবং বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেন স্থানীয়রা।

তবে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে পুনরায় চালু করে একইরকম অনিয়ম শুরু করেছে হাসপাতালটির পরিচালনাকারীরা।  

এইচকে/জেএস