বান্দরবানের পাহাড়ে ১১টি জাতিগোষ্ঠীর বাস। এসব গোষ্ঠীর নারী সদস্যরা প্রায় সবাই কম-বেশি কোমরতাঁত তৈরি করেন। আদিবাসী নারীরা বাঁশের কাঠি দিয়ে বিশেষ কায়দায় কোমরের সঙ্গে বেঁধে তাঁতের কাপড় বুনে থাকে বলে এটিকে কোমরতাঁত বলা হয়।

পাহাড়ি নারীদের হাতে তৈরি থামি, পিনন, ওড়না, রুমাল, গামছা বা চাদর পাহাড় ছড়িয়ে সমতলেও ব্যাপক সমাদৃত। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এ শিল্প এখনও বাড়ির উঠানেই আটকে আছে।

এ শিল্পকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোমরতাঁতে ঘুরছে পাহাড়ি নারীদের জীবন চাকাও।

কোমরতাঁত পার্বত্য জনপদে নারীদের উপার্জনের অন্যতম প্রধান খাত। এ খাত থেকে আয় হলেও নেই সরকারি-বেসরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে বাণিজ্যিক উদ্যোগে নয়, পাহাড়ি নারীরা ব্যক্তি উদ্যোগে বাঁচিয়ে রেখেছে এই শিল্পকে।

স্থায়ীভাবে কোনো বাজার গড়ে না উঠলেও বান্দরবানের পর্যটনস্পট শৈলপ্রপাতে পাহাড়ি বম নারীরা নিজ উদ্যোগে একটি অস্থায়ী বাজার গড়ে তুলেছেন। সেখানে খ্রিস্টীয় চার্চ সমিতির পক্ষ থেকে স্থায়ীভাবে কয়েকটি ছোট বাজার শেডও তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। রোববার ছাড়া সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে সকাল-সন্ধ্যা পাহাড়ি বম সম্প্রদায়ের নারীরা কোমরতাঁতে বোনা কাপড় বিক্রি করে থাকেন।

কোমরতাঁতে তৈরি কাপড় বিক্রি করে বান্দরবানের ফারুকপাড়া, লাইমীপাড়া, স্যারণপাড়া, লাইলুনপিপাড়া ও গেজমনিপাড়ায় বসবাসরত পাহাড়ি নারীরা অনেকটা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।

বান্দরবানের বেশির ভাগ পাহাড়িপল্লিতেই চলে কোমরতাঁতের সাহায্যে কাপড় বুননের কাজ। গৃহস্থালির কাজ আর জুম চাষের ফাঁকে কোমর তাঁতে পিনন ও থামি তৈরি করে স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করে থাকেন তারা। কাপড় বুনে প্রতি মাসে এক জন নারী সাত থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, একসময় পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত তুলা থেকে চরকার সাহায্যে সুতা তৈরি করে পিনন ও থামির কাজ করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি পাহাড়ি এলাকায় তুলার উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং তুলা থেকে সনাতনি পদ্ধতিতে সুতা তৈরি সময় সাপেক্ষ হওয়ায় বাজার থেকে সুতা কিনেই কাপড় বুনতে হচ্ছে।

তবে কোমরতাঁতে আধুনিক প্রযুক্তির বদলে এখনও কাপড় বোনার জন্য পাহাড়ি নারীরা বাঁশ ও কাঠের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকেন। কোনোপ্রকার পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কোমরতাঁতের সঙ্গে জড়িত নারীরা বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা স্বাবলম্বী হতে পারতেন। কিন্তু পুঁজি স্বল্পতার কারণে তারা উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না।

ফারুকপাড়ার কোমরতাঁত শিল্পী লিমা বম বলেন, দশকের পর দশক ধরেই পাহাড়ি নারীরা এ পেশায় যুক্ত। একটি থামির কাজ শেষ হতে ৪ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। ভালোমানের একটি থামি বিক্রি করে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা আয় করা যায়।

বম জনগোষ্ঠীর তরুণী মুমু বম জানান, শিমুলতুলা থেকে চরকার মাধ্যমে সুতা তৈরি করা হয়। সে সুতায় রং লাগিয়ে কোমরতাঁতের মাধ্যমে কাপড় তৈরি করা হয়।

কোমরতাঁত শিল্পী নু মার্মা বলেন, একটি থামি বুনতে সময় লাগে সাত দিন। খরচ হয় ৩০০ থেকে ৩৫০০ টাকা। থামি বিক্রি করেন ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকায়। প্রতিমাসে এভাবে তাদের আয় দাঁড়ায় ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা।

বান্দরবানে বার্মিজ মার্কেটের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয়দের পাশাপাশি পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে কোমরতাঁতে তৈরিকৃত পণ্য জনপ্রিয় হওয়ায় দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে।

এছাড়াও শহরের মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স, মাস্টার মার্কেট, পূরবী মাকের্ট, কেএস প্রু মার্কেটসহ স্থানীয় বাজারগুলোতে পাহাড়ি নারীদের তৈরি কোমরতাঁতের বিভিন্ন রকমের কাপড় বিক্রি হচ্ছে।

জেলা কুটিরশিল্প সংস্থার মতে, বান্দরবান জেলায় প্রায় ১০ হাজার পাহাড়ি নারী কোমরতাঁতে কাপড় তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। পাহাড়ি নারীরা কোমরতাঁতে তৈরি করছেন, থামি (পরনের কাপড়), গামছা, কম্বল, রুমাল, গায়ের শাল, টুপি, ওড়না, বিছানার চাদরসহ রকমারি জামা কাপড়।

জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা আতিয়া ইসলাম জানান, বসবাসরত ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, বম, খুমী, লুসাই, পাংখোয়া, চাক, খেয়াং ও মুরং সম্প্রদায় কোমরতাঁতে কাপড় বুনে থাকেন। তরুণীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কোমরতাঁতে শেখাতে সাহায্য করে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) বান্দরবান উপ-ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) হাসান আসিফ চৌধুরী বলেন, কোমরতাঁত পাহাড়ি জনপদের প্রাচীন পেশা। কোমরতাঁতের ওপর অনেক পরিবার নির্ভরশীল। দক্ষতা ও যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে কোমরতাঁত উদ্যোক্তারা চাইলে করপোরেশনের পক্ষ থেকে অর্থসহায়তা দেওয়া হবে।

এমএসআর