রূপপুর যেন ‘রুশপুর’
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। মাত্র ছয় বছর আগে যে এলাকা সীমাবদ্ধ ছিল ফাঁকা মাঠ আর কাঁটাতারের বেড়ায় আটকানো দু-একটি অস্থায়ী স্থাপনায়। সেই এলাকায় ২০১৭ সালে দেখা যায় কিছু দোকানপাট আর অট্টালিকার। আস্তে আস্তে মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। সেখানে এখন চলছে মহাকর্মযজ্ঞ। রাশিয়ানদের পদচারণায় তা রুশপল্লিতে পরিণত হয়েছে। বলছিলাম পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের কথা।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের কল্যাণে এলাকার দৃশ্যপট পুরোটাই পাল্টে গেছে। এলাকার-বিপণিবিতান, বিদ্যালয়, সুউচ্চ ভবন, আন্তর্জাতিক মানের হোটেল-রেস্টুরেস্ট, রিসোর্ট এখন মুখরিত। এখানকার কাঁচা বাজারগুলোতেও যেন রাশিয়ানদের ছোঁয়া লেগেছে। দোকানের সাইনবোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষাও লেখা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ফল ও সবজি বিক্রেতারাও রাশিয়ান ভাষা শিখেছেন। তারা রাশিয়ান ভাষায় কথা বলছেন। তাদের মতে, রাশিয়ানদের সঙ্গে মালামাল ক্রয়-বিক্রয় করতে করতে তাদের ভাষা শিখেছেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ পরিবর্তনের পেছনে ভূমিকা রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের। শুধু রূপপুর নয়, পার্শ্ববর্তী পাকশী, সাহাপুর ও ঈশ্বরদী শহরেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। পাল্টে গেছে জীবনচিত্র।
পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর পাশেই নদীতীরে চলছে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের সবচেয়ে মেঘা প্রকল্পের কাজ। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ শুরুর পর থেকে বদলে যেতে থাকে এলাকার চিত্র। পাল্টে যায় জীবনযাত্রার মান।
রূপপুর প্রকল্পে কাজের সুযোগ পেয়েছেন কয়েক হাজার বেকার যুবক। তাদের ভাগ্য যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে সামাজিক চিত্রও। বেড়েছে জমির দাম।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস জানান, এই প্রকল্পে কমবেশি ২০ হাজার প্রকৌশলী-শ্রমিক সর্বদা কাজ করছেন। রাশিয়া, বেলারুশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় দুই হাজার বিদেশি শ্রমিক ও কর্মকর্তারা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। বাকিরা এ দেশের।
এর বাইরে চারপাশে গড়ে ওঠা হোটেল, রিসোর্ট, বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো কর্মহীন মানুষের। বিদেশি নাগরিকদের কেনাকাটাসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজন মেটাতে পাকশী, সাহাপুর, রূপপুর ও ঈশ্বরদী শহরে গড়ে উঠেছে একাধিক বিপণিবিতান, আধুনিক শপিংমল, সুপার শপ, রিসোর্ট ও তারকা হোটেল। উন্নতমানের হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের কারণে উপজেলার প্রায় সব এলাকার রাস্তাঘাট নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বড় পরিবর্তন। ঈশ্বরদী উপজেলা প্রকৌশলী এনামুল কবীর জানান, প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই উপজেলায় ১০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে। নতুন করে ঈশ্বরদীতে ২৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এই কয়েক বছরে যতটা উন্নয়ন হয়েছে বিগত ৫০ বছরেও এমন কাজ হয়নি।
পশ্চিম রেল পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) শাহিদুল ইসলাম জানান, রূপপুর প্রকল্পের ভারী যন্ত্রপাতি রেলপথে আনা-নেওয়ার জন্য ৩৩৫ কোটি টাকা খরচে ২৬ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মিত হয়েছে।
গ্রীনসিটির সামনে বিশ্বাস মার্কেটের ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী, রেজাউল করিম, মেহেদী হাসান মামুনসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, রূপপুর প্রকল্পে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ায় দোকানে নতুন নতুন ক্রেতা আসছে। আগের চেয়ে ব্যবসা ভালো হচ্ছে।
তারা আরও বলেন, প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি গ্রিনসিটি গড়ে তুলেছে সরকার। এতে থাকছেন প্রকল্পের কর্মীরা। অনায়াসে তাদের সঙ্গে আমরা ব্যবসা করছি। অনেকেই এখন পরিচিত বন্ধুর মতো আচরণ করেন। অবসর সময়ে আমরা রাশিয়ানদের সঙ্গে আড্ডাও দিয়ে থাকি।
এলাকার রিসোর্টগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অনেক রুশ নাগরিক অবসর সময় কাটাচ্ছেন। স্থানীয় স্বপ্নদ্বীপ, পাকশী রিসোর্ট, হার্ডিঞ্জ সেতুতে শুক্রবার ও শনিবার রাশিয়ানদের পদচারণায় মুখর।
বিক্রয়কর্মী রেদওয়ান আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে রুশ ভাষায় সব কিছু লেখা রয়েছে। পোশাক-আসবাবপত্রের দাম ও মান সবই আমরা রাশিয়ান ভাষায় বলে থাকি। ইংরেজি না বোঝায় প্রথম দিকে বিড়ম্বনার সম্মখীন হলেও এখন আর সমস্যা হয় না। এখানে যারা ব্যবসা করছেন বা করবেন সবাইকে রাশিয়ান ভাষা শিখতে ও জানতে হবে। কাঁচামাল বিক্রেতারাও রাশিয়ান ভাষা শিখছে।
ঈশ্বরদীর সিনিয়র সাংবাদিক খন্দকার মাহবুবুল হক দুদু বলেন, উন্নয়নের ছোঁয়ায় রূপপুর এখন পাল্টে গেছে। সবার জীবনযাত্রার মান কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে গর্ববোধ করি।
ঈশ্বরদী উপজেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ কিরণ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভাব-অনটনের কারণে আগে এসব গ্রামে প্রায়ই পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহ, দেনা-পাওনার নালিশসহ নানা ধরনের কলহ নিরসন করতে বিচার সালিস করতে হতো। বেকারত্ব দূর হওয়ায় গ্রামে এখন আর সে পরিবেশ নেই। পারিবারিক, সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরেছে। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের পদচারণা রয়েছে এখানে। সব মিলে রূপপুর এখন যেন রুশ নগরীতে পরিণত হয়েছে।
রূপপুরের মস্কো ডেন্টাল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. হাসান ইকবাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাশিয়ানদের দাঁতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তারা হাসপাতালে চলে আসে। এক্ষেত্রে তাদের ভাষা শুনে আমাদের চিকিৎসা দিতে হয়। দাঁতের হালকা সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের দারস্থ হন। প্রথম দিকে সমস্যা হলেও এখন আর হয় না।
উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ সময় পার হলেও সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে উদ্যোগটিতে গতি আসে। চুক্তি হয় রাশিয়ার সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের অক্টোবরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পুরোদমে কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর।
এক হাজার ৬২ একর জমির ওপর স্থাপিত ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে থাকছে দুটি ইউনিট। প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করবে। প্রথম ইউনিটে বহুল প্রতীক্ষিত পারমাণবিক চুল্লিপাত্র অর্থাৎ নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভ্যাসেল বসানো হয়েছে।
এসপি