গেল বছর গোটা বিশ্ব করোনার থাবায় নাস্তানুবাদ হয়েছিল। বর্তমানে তা অনেকটাই সহনীয়। অদৃশ্য করোনায় এখন মৃত্যুর হার কমে এসেছে। তবে কমেনি আক্রান্তের সংখ্যা। এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে করোনার প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ নিয়ে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। সম্প্রতি (২১ জানুয়ারি) ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে উপহার দেওয়া কোভিশিল্ড নামের ভ্যাকসিনের ২০ লাখ ডোজ ঢাকায় এসে পৌঁছেছে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় একজন নার্সকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে করোনা টিকা প্রয়োগ শুরু হবে। পরে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে সারাদেশে একযোগে টিকাদান। এদিকে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপির বক্তব্য আর বিরোধী জোটের নেতাদের পাল্টা বক্তব্য বিনিময় চলছে প্রতিদিন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মনে ‘ভীতি’ সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও সচেতন মহল থকে সাধুবাদ জানানো হচ্ছে সরকারের প্রতি। দ্রুত সময়ের মধ্যে করোনা মোকাবিলায় টিকা প্রদানের প্রস্তুতি নেওয়ায় খুশি সবাই। তবে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা করোনার প্রথম ধাপের নমুনা পরীক্ষার কেলেঙ্কারির মতো যেন ভ্যাকসিন নিয়ে নতুন কোনো ঘটনার আর মঞ্চায়ন না হয়।

রোববার (২৪ জানুয়ারি) দুপুরে বিভাগীয় শহর রংপুরে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। বেশির ভাগ মানুষের একটা দাবি, সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হোক ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম। দূর হোক মানুষের মনের ভীতি।

নগরীর শাপলা চত্বরে কথা হয় স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী এস এম জাকির হুসাইনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার নিয়ে প্রথম ধাপে দেশে নমুনা পরীক্ষা নিয়ে যে ধরনের জটিলতা ও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এবার যেন ভ্যাকসিন প্রয়োগে এমনটা না হয়। এটা নিয়ে কোনো রাজনীতি, অনিয়ম বা দুর্নীতি যেন না হয়, এ জন্য সরকারপ্রধানকে সজাগ থাকতে হবে। কারণ তাকে (প্রধানমন্ত্রী) ছাড়া সাধারণ মানুষ আর কারও ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। আমি চাই করোনা মোকাবিলায় যেসব সম্মুখযোদ্ধা মাঠে ছিলেন, তাদের আগে ভ্যাকসিন দেওয়া হোক। সঙ্গে ভ্যাকসিন প্রয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুর্নীতিমুক্ত মানুষদের নিয়োগ দিতে হবে।

পার্কের মোড় আশরতপুর এলাকার বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম। পেশায় তিনি একজন উদ্যোক্তা। সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বেশির ভাগ সময়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যে উপহারস্বরূপ ভারত থেকে পাঠানো ২০ লাখ ভ্যাকসিন  গ্রহণ করেছে। করোনার এই প্রতিষেধক আসার পর থেকে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা দেখছি, বিএনপি এই ভ্যাকসিন প্রথমে আওয়ামী লীগকে নিতে বলছে। আওয়ামী লীগ আবার বিএনপি টিকা নিতে বলছেন। এই রাজনীতি বন্ধ করে করোনা মোকাবিলায় ভ্যাকসিনটা সর্বজনীন হওয়া এখন সময়ের দাবি।

স্টেশন রোডে কথা হয় কয়েকজন ভ্যানচালক ও অটোশ্রমিকদের সঙ্গে। তারা বলেন, এখন যে রাজনীতি শুরু হইছে। তাতে আমরা গরিব মানুষ ভ্যাকসিন পাব কি না সন্দেহ। শোনা যাচ্ছে আগে নাকি বড়লোকেরা পাবে। চাকরিজীবীরা পাবে। ওনারা যদি পায়, তাহলে তো গরিবেরও প্রয়োজন আছে। আমরা অসহায় গরিব মানুষ। আমরা চাই সবাই যেন সমান অধিকার নিয়া এই ভ্যাকসিন পায়। যাতে ভ্যাকসিন নিয়া কোনো দুর্নীতি-অনিয়ম না হয়, সেটাও দেখতে হবে।

রিকশাচালক নজু বলেন, হামরা তো টিকা কিনবার পামো না। সরকার যদি ব্যবস্থা করি দেয়, তাইলে ভালো হইবে। তা ছাড়া তো হামার পাবার কোনো সম্ভাবনা নাই।

কবি ও লেখক হায়াত মাহমুদ মানিক বলেন, ভ্যাকসিন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আছে। ফেসবুকে কিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে। মানুষের মৃত্যু নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এটা বিশ্বাস করা যাবে না। বরং করোনার ভ্যাকসিন যাদের প্রয়োজন, তাদের আগে দেওয়া হোক। বিশেষ করে পুলিশ, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শ্রমিক, দিনমজুরসহ যারা মাঠে থাকেন, তাদের আগে টিকা দেওয়া দরকার। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটাই দাবি করছি।

ভ্যাকসিন সবার জন্য দরকার বলে মনে করছেন ট্রাকশ্রমিক আবুল মিয়া। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা দিলে তো মানুষ ভালো থাকবে। যতদিন বেঁচে থাকবে, সমস্যা হবার কথা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার অনুরোধ, যেন গরিবের জন্য ভ্যাকসিনের তিনি একটা সুব্যবস্থা করেন।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় একজন নার্সকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে করোনা টিকা প্রয়োগ শুরু হবে। এ ছাড়া এদিন আরও ২৪ জনকে টিকা দেওয়া হবে। ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে কয়েক শ জনকে টিকা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে ৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে টিকাদান শুরু হবে।

রংপুর প্রেসক্লাব এলাকার পান দোকানদার হারুন উর রশিদ বলেন, টিভিতে দেখেছি করোনার টিকা ভারত থেকে আমাদের দেশে পাঠানো হয়েছে। এটা নাকি প্রথম সারির লোকেরা আগে পাবে। আমি চাই আমাদের মতো লোকেরাও যেন পায়। এতে আমরা উপকৃত হব।

মাহিগঞ্জ থেকে নগরীর কাঁচাবাজারে আসা একজন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেসব দেশে করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে, সেখানে তো এর কার্যকারিতার কোনো গ্যারান্টি এখনো দেওয়া হয়নি। এই পরিস্থিতিতে আমাদের টিকা গ্রহণের আগে ভাবতে হবে। ভ্যাকসিন দিয়ে যে কাজ হবে, তার কি গ্যারান্টি আছে। যদি সরকার গ্যারান্টি দিতে পারে, তাহলে শুধু আমি কেন, সবাই টিকা নিতে চাইবে।

সমাজ উন্নয়নকর্মী রেজাউল করিম জীবন বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনার টিকা দেওয়া শুরু হলে আমি সবার আগে নিতে আগ্রহী। এখনো যদি বলা হয় তাতেও আমার আপত্তি নেই। এটা নিয়ে কিছু মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়াচ্ছে। মানুষের আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। কিন্তু ভ্যাকসিন নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু আছে বলে আমরা মনে হয় না।

এদিকে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষের মনে সৃষ্ট ‘ভীতি’ দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেছেন, বিশ্বের যেকোনো ভ্যাকসিনের চেয়ে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সবচেয়ে কম, এ জন্য এটা নিরাপদ। আপনারা সবাই ভ্যাকসিন নেন।

রোববার (২৪ জানুয়ারি) দুপুরে করোনার ভ্যাকসিন বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান।

এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এটা জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। আমরা মানুষকে বিভ্রান্ত না করার আহ্বান জানাব। আমরা আশা করি, মানুষ এ বিষয়ে সচেতন। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি ভালো। এর গুরুতর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। যদি হয়, সরকার সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা দেবে।

ভ্যাকসিনের পার্শপ্রতিক্রিয়া খুব সামান্য। ওষুধ ও সব ভ্যাকসিনেই সামান্য পার্শপ্রতিক্রয়া থাকে, এটা সবার জানা। এটা নিলে জ্বর মাথাব্যাথা হতে পারে, যোগ করেন তিনি।

মন্ত্রী বলেন, টিকাদান কর্মসূচির অনেক অভিজ্ঞতা আছে বাংলাদেশের। টিকাদানের মাধ্যমে পোলিও, ধনুষ্টঙ্কারসহ বেশ কয়েকটি রোগ নির্মূল হয়েছে। প্রতিবছর দেশে কোটি কোটি শিশুকে টিকা দেওয়া হয়।

জাহিদ মালেক বলেন, ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, জোর করে কাউকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে না। তবে, যারা মানুষের জীবন নিয়ে ষড়যন্ত্র ও রাজনীতি করতে চান, তারা ভালো মানুষ না। কোভিড মোকাবিলা করে আমরা মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছি।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ২১ জানুয়ারি দেশে এসেছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উপহার দেওয়া ভ্যাকসিন। আগামীকালের মধ্যে আরও ৫০ লাখ টিকা বাংলাদেশে আসছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

এখন চলছে ভ্যাকসিন প্রয়োগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। এরই মধ্যে সংক্রমণের হার ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় সারাদেশের কোন কোন জেলায় কত সংখ্যক ভ্যাকসিন যাবে, তা-ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সারাদেশে তিন ধাপে প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়া হবে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় একজন নার্সকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে করোনা টিকা প্রয়োগ শুরু হবে। এ ছাড়া এদিন আরও ২৪ জনকে টিকা দেওয়া হবে। ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে কয়েক শ জনকে টিকা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে ৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে টিকাদান শুরু হবে।


বিভাগীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন প্রদানে পরিকল্পনা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যানে দেখা গেছে, দেশের ৬৪ জেলাতেই প্রথম ধাপে পর্যায়ক্রমে টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে টিকা দেওয়া হবে ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪৫ জনকে। চট্টগ্রাম বিভাগে ২৯ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৩ জনকে, রাজশাহী বিভাগে ১৯ লাখ ২৪ হাজার ৯২২ জনকে, রংপুর বিভাগে ১৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯ জনকে, খুলনা বিভাগে ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬৪৬ জনকে, সিলেট বিভাগে ১০ লাখ ৩২ হাজার জনকে এবং বরিশাল বিভাগে আট লাখ ৬৬ হাজার ৯৯৪ জনকে টিকা দেওয়া হবে। তিন রাউন্ডে এই মোট জনগোষ্ঠী টিকা পাবেন।

রংপুর বিভাগের আটটি জেলায় ১৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯ জনকে টিকা প্রদান করা হবে। এর মধ্যে রংপুর জেলায় ৩ লাখ ২২ জন, দিনাজপুরে ৩ লাখ ১১ হাজার ৩৭৭ জন, কুড়িগ্রামে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৮৪ জন, লালমনিরহাটে ১ লাখ ৩০ হাজার ৮০৪ জন, গাইবান্ধায় ২ লাখ ৪৭ হাজার ৭৬৪ জন, নীলফামারীতে ১ লাখ ৯১ হাজার ৮ জন, পঞ্চগড়ে ১ লাখ ২ হাজার ৮৪৮ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫২ জন রয়েছে।

যেসব স্থানে দেওয়া হবে টিকা
করোনাভাইরাসের টিকা প্রয়োগের জন্য সরকার কিছু জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা/সদর হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, পুলিশ-বিজিবি হাসপাতাল ও সিএমএইচ, বক্ষব্যাধি হাসপাতালে এ টিকা দেওয়া হবে। এসব জায়গায় প্রথম ধাপের ৫০ লাখ ভ্যাকসিন দিতে ৭ হাজার ৩৪৪টি দল গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি দলে দুজন সরাসরি ভ্যাকসিন দেবেন এবং বাকি চারজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অন্যান্য কাজ করবেন।

এনএ