পীরগঞ্জের ঘটনায় কারমাইকেলের ছাত্রলীগের সহসভাপতির সম্পৃক্ততা
রংপুরের পীরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গ্রেফতার সৈকত মন্ডল ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন বলে জানা গেছে। কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দর্শন বিভাগের কমিটির সহসভাপতি পদে ছিলেন তিনি। পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ার ঘটনার এক দিন পর (১৮ অক্টোবর) তাকে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
শনিবার (২৩ অক্টোবর) বিকেলে ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রংপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ আসিফ হোসেন।
বিজ্ঞাপন
তিনি জানান, চার বছর আগে ২০১৭ সালের ৮ মে দর্শন বিভাগের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটিতে সহসভাপতি পদে ছিলেন সৈকত মন্ডল। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপের অভিযোগ পাওয়া যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ অক্টোবর তাকে ছাত্রলীগের কমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ছাত্রলীগের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই তার।
মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, সৈকত মন্ডলের বাড়ি পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামে। সম্প্রতি এলাকায় অবস্থানকালে তিনি দলীয় আদর্শবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত হন। বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে উসকানি ও বিদ্বেষমূলক পোস্ট ও মন্তব্য করতেন। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টার অভিযোগ পাওয়ায় ১৮ অক্টোবর তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এদিকে সৈকত মন্ডলকে কমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমরা যখনই তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট ও কমেন্টস করার অভিযোগ পেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে তাকে কমিটি থেকে বহিষ্কার করেছি। একই সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতাদের বিষয়টি জানিয়েছি।
পীরগঞ্জে হামলার ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না, জানতে চাইলে সিজার বলেন, এটিও প্রশাসন তদন্ত করে জানাবে। তবে আমরা শুনেছি, সৈকত ঘটনার আগ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এসব নিয়ে লেখালেখি করত। এটি আমাদের ছাত্রলীগের রাজনীতির পরিপন্থী। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
গ্রামের বাড়ি মাঝিপাড়া এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৈকতের বাবা রাশেদুল ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন। তবে সৈকতের দাদা আবুল হোসেন মণ্ডল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে রয়েছেন। চাচা রেজাউল করিমও সংশ্লিষ্ট ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। সৈকত কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলেও আগে থেকেই ছিলেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন।
স্থানীয়দের দাবি, ঘটনার পর সৈকত মন্ডল, রবিউল ইসলামসহ অনেকেই গ্রাম থেকে আত্মগোপনে চলে যান। আজ হঠাৎ করেই তারা টেলিভিশনে সৈকত ও রবিউলের গ্রেফতার হওয়ার খবর জানতে পারেন।
তবে তার পরিবারের দাবি, সৈকত মন্ডল নির্দোষ এবং ঘটনাক্রমে ষড়যন্ত্রের শিকার। পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করার দাবি করে তার চাচা রেজাউল করিম বলেন, আমার ভাতিজা সৈকত মণ্ডল ঘটনার দিন দক্ষিণ মাঝিপাড়ায় অবস্থান করছিল। সেখানে পুলিশ ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম ছিলেন। সেখানে সৈকত উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে। সবাইকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করে পরিতোষ সরকারের ধর্ম অবমাননার বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে অনুরোধ করে। এ কারণে পুলিশ তখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিতোষকে গ্রেফতারের আশ্বাস দেয়। কিন্তু এরই মধ্যে উত্তর মাঝিপাড়ায় আগুন লাগে। এর সঙ্গে সৈকতের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমার ভাতিজা নির্দোষ ও নিরপরাধ।
সৈকতের দাদা আবুল হোসেন মণ্ডল বলেন, আমরা নয়া আওয়ামী লীগ করি না। এখন তো অনেক হাইব্রিড নেতা। আমি বহু পুরাতন মানুষ। সেই বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। যখন এলাকায় কেউ আওয়ামী লীগ করার সাহস পায় নাই, তখন থেকেই আওয়ামী লীগ করছি। নৌকা ছাড়া কিছু বুঝি না। আমরা নাতিও ছাত্রলীগ করে। এই কাম কি হামার ঘরের ছাওয়া করিবার পারে? এটা নতুন ষড়যন্ত্র, তদন্ত করা দরকার।
সৈকতের মা আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ঘটনার পর চেয়ারম্যান হামাক বাড়ি থাকি সারি থাইকপার কইছে। সাথে সাথে স্বামী আর সন্তান (সৈকত মন্ডল)সহ পলাশবাড়িত যাই। ওই জাগা থাকি অনেকের বাড়িত গেছি। অটে কোনা (সেখানে) র্যাব হামাক ধরি ফেলায়। তখন সৈকতের কোন্টে আছে, সেই কথা র্যাবোক জানাছি। কিন্তু হামার সৈকত কোনো অন্যায় করে নাই।
এদিকে উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়া ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার অন্যতম হোতা অভিযোগে সৈকত মন্ডল ও সহযোগী রবিউল ইসলামকে টঙ্গী থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। শনিবার (২৩ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকার কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গ্রেফতারের তথ্যটি নিশ্চিত করেন।
সাংবাদিকদের খন্দকার আল মঈন বলেন, ফেসবুকে ফলোয়ার প্রায় তিন হাজার। ফলোয়ার আরও বাড়াতে ও ব্যক্তিগত ইমেজকে প্রচার করতেই ‘এ মুহূর্তে গ্রাম পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদ, হিন্দুদের আক্রমণে এক মুসলিমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে’ মর্মে উসকানিমূলক পোস্ট দেন সৈকত মন্ডল। সেই পোস্টের সূত্র ধরে হামলাস্থলের ঠিক কাছাকাছি একটি মসজিদ থেকে মাইকিং করেন সহযোগী রবিউল ইসলাম। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পীরগঞ্জে ঘটনায় তারা সংশ্লিষ্টতার তথ্য দিয়েছেন সৈকত মন্ডল (২৪) ও রবিউল ইসলামকে (৩৬)।
তিনি বলেন, গ্রেফতার ব্যক্তিরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অরাজকতা সৃষ্টি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের লক্ষ্যে হামলা-অগ্নিসংযোগসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার ও মাইকিং করে হামলাকারীদের জড়ো করেন বলে জানান।
গ্রেফতার সৈকত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক, বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণকে উত্তেজিত করে তোলেন। তিনি হামলা ও অগ্নিসংযোগে অংশগ্রহণে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেন। তার নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন হামলায় সরাসরি অংশ নিয়ে বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তিনি গ্রেফতার রবিউলকে মাইকিং করে লোকজন জড়ো করতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন বলে জানান। ঘটনার পরপর তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, এর আগে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন পরিতোষ ও উজ্জ্বল। ফেসবুকে উসকানিমূলক মূল পোস্টটি দিয়েছিলেন পরিতোষ। পরিতোষ আর উজ্জ্বলের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক ছিল। পরিতোষ পোস্ট দিয়ে উজ্জ্বলকে বলেন, ধর্মীয় উসকানিমূলক পোস্ট দিলে তোর কেমন লাগে! এরপর পোস্টটি সে ডিলিট করলেও উজ্জ্বল তা কপি ও সেভ করেন। এরপর সেটিই উজ্জ্বল নিজের ফেসবুক পেজ থেকে প্রচার করেন। এরপর সেই পোস্টটি পিক করেন সৈকত। সৈকতের মাধ্যমে সেটি জেনেই রবিউল মসজিদে মাইকিং করেন ও হামলার নেতৃত্ব দেন এবং নিজেও অংশ নেন।
গ্রেফতার রবিউল রংপুরের পীরগঞ্জের হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অন্যতম উসকানিদাতা। তিনি স্থানীয় একটি মসজিদের মুয়াজিন। হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার আগে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাইকিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন উসকানিমূলক ও মিথ্যাচার করে গ্রামবাসীকে উত্তেজিত করে তোলেন এবং হামলায় অংশগ্রহণের জন্য জড়ো হতে বলেন। তিনি মাইকিংয়ের দায়িত্ব তার আস্থাভাজনকে দিয়ে নিজে সশরীরে অংশগ্রহণ ও নির্দেশনা দেন।
গ্রেফতার সৈকতের নির্দেশনায় ও প্ররোচনায় তিনি মাইকিং করাসহ হামলায় অংশগ্রহণ করেন। ঘটনার পর তিনিও আত্মগোপনে চলে যান। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, গত ১৭ অক্টোবর রাতে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর মাঝিপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গ্রামটির ১৫টি পরিবারের ২১টি বাড়ির সবকিছু আগুনে পুড়ে গেছে। সব মিলিয়ে অন্তত ৫০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। হামলাকারীরা গরু-ছাগল, অলংকার, নগদ টাকাও নিয়ে গেছেন বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্তদের। এ ঘটনায় পীরগঞ্জ থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে তিনটি মামলা করা হয়েছে। এতে গত ছয় দিনে ৫৮ জন গ্রেফতার হয়েছেন।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এনএ