ছাত্রের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন শিক্ষক- এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। শেয়ার, কমেন্টস আর লাইক-রিয়্যাক্টে প্রশংসায় ভাসছেন ছাত্র-শিক্ষক উভয়ই। অনেকেই ভাবছেন, এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা। হ্যাঁ, স্বাভাবিক। কিন্তু ছবিটা যখন একজন প্রতিমন্ত্রী ও তার স্কুলজীবনের শিক্ষকের, তখন তো এ ছবির অর্থটা একটু অন্য রকম।

বর্তমানে শিক্ষার্থীদের শাসন করা শিক্ষকের বারণ। এখন শিক্ষকের হাতে শাসনের লাঠি নেই। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের শ্রদ্ধার সম্পর্কটাও অনেকটা তিতা হয়ে গেছে। সম্প্রতি ছাত্রের মাথার লম্বা চুল কেটে দেওয়া নিয়ে শিক্ষক যখন সমালোচনার মুখে, ঠিক তখন ছাত্র-শিক্ষকের আস্থা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার একটি ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে।

ফেসবুকে প্রশংসা কুড়ানো ছবিটি ডা. এনামুর রহমানের। তিনি বর্তমান সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের একজন রাজনীতিবিদ। ফেসবুকে পোস্ট করা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বনমালী পাল তার প্রাক্তন ছাত্র প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করছেন।

বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) রংপুর সফরে এসে প্রতিমন্ত্রী তার স্কুলজীবনের প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে তোলা ওই ছবিটি রাত ১০টা ২৫মিনিটে নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেন। মুহূর্তেই ছবিটি বিভিন্নজন শেয়ার করেন ও লাইক দেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছবির নিচের কমেন্টস বক্সে বাড়তে মন্তব্য। 

সেখানে প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান লিখেছেন- ছাত্রকে আশীর্বাদ করছেন শিক্ষক। তাঁর সেই দুরন্ত ছাত্র এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের প্রতিমন্ত্রী। আর সেই শিক্ষার্থী যদি সরকারি সফরে শিক্ষকের বাড়ির আঙিনায় কাছে আসে তখন শিক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করা পর্যন্ত ছাত্রের সফরের পরিপূর্ণতাও আসে না। বলছি, আমার স্কুলশিক্ষক শ্রদ্ধেয় বনমালী পালের কথা। আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে বিভাগীয় শহর রংপুরে। ১৯৭৩ সালের কথা। আমি তখন রবার্টসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরিক্ষার্থী‌। স্যার আমাদের পড়াতেন ইংরেজি।

প্রতিমন্ত্রী নিজের স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ছাত্র হিসেবে আমি ছিলাম বেজায় ডানপিটে। কেবলমাত্র ডানপিটে স্বভাবের কারণেই যে স্যারের হাতে কত পিটুনি খেয়েছি তার কোনো হিসেব নেই। আমার সেই প্রাণের শিক্ষকদের শাসনেই আজ আমি আপনাদের প্রিয় ডা. এনাম। নানান ব্যস্ততার মাঝেও আমি চেষ্টা করি আমার সেই প্রিয় শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে। স্যারদের নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়াটা আমার রুটিন কাজ। তাঁদের চিকিৎসা থেকে নানান প্রয়োজনে যখনই পাশে থাকার সুযোগ পাই তখন ছাত্র হিসেবে নিজেকে সার্থক এবং গর্বিত মনে হয়। সৌভাগ্য নিজের জীবদ্দশায় প্রিয় শিক্ষকদের আশীর্বাদের ছায়া এখনো ঘিরে রেখেছে আমাকে। স্যারের জন্য পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

রংপুর নগরের রবার্টসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বনমালী পাল। তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর শিক্ষকতা করেছেন। অবসর নিয়েছেন ২০০৫ সালে। তারপরও তার জীবনে অবসর আসেনি। বর্তমানে তিনি স্থানীয় মুসলিম উদ্দিন কিন্ডার গার্টেনের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ৮০ বছর বয়সী এই শিক্ষক এখনো শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিকতার আলোয় রংপুরকে আলোকিত করে চলেছেন।

ফেসবুকে প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে ছবিসহ পোস্ট দেওয়া প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বনমালী পাল আমার রংপুরে আসার কথা শুনে নিজে বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আমি তাঁকে দেখে ভীষণ আনন্দিত হয়েছি। তাঁকে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে বরণ করেছি। তিনিও আমাকে আশীর্বাদ করেছেন।

তিনি আরও বলেন, শুধু স্কুল নয়, আমার শিক্ষাজীবনে স্কুল, কলেজ ও মেডিকেল কলেজের সমস্ত শিক্ষকের সঙ্গে আমি একটা সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করি। তাদের বিপদের দিনে আমি চেষ্টা করি পাশে থাকতে। বনমালী পাল স্যার কয়েক বছর আগে অসুস্থ হয়েছিলেন। আমি তাঁকে রংপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে এসে চিকিৎসা করিয়েছি। এখন তিনি সুস্থ আছেন।

বর্তমান সময়ে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ও সত্তর-আশির দশকের সম্পর্ক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের সময়ে কঠিন শাসন ছিল। কোনো অনিয়ম, দুষ্টুমি করলে আমরা মার খেতাম। শিক্ষকেরা আমাদের বেত দিয়ে প্রচণ্ড মারতেন। কখনো কখনো মারতে মারতে বেত ভেঙে ফেলতেন। আবার আমরা যখন শান্ত থাকতাম, ভালো পড়ালেখা করতাম, তখন শিক্ষকরা অনেক ভালোবাসতেন। অনেক শিক্ষক বুকে জড়িয়ে ধরতেন। আমরা একটা পড়া একবার না বুঝলে শিক্ষকেরা আমাদের ১০ বার বুঝাতে চেষ্টা করতেন।

তিনি বলেন, আমাদের সময়ে পরিবারের অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের ভালো সম্পর্ক ছিল। এখনো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রদের ভালোবাসেন, তাদের খোঁজখবর নেন। কিন্তু এখন আর আগের মতো হয়তো ছাত্র পেটানোর সেই রীতি নেই। এখন শুধু এটাই ব্যতিক্রম। কিন্তু শিক্ষক সব সময়ই পিতৃতুল্য। এখনো শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক ভালো। শিক্ষক-ছাত্রদের ভালোবাসাও আছে।

এদিকে ফেসবুকে ডা. এনামুর রহমানের দেওয়া পোস্টটি দেখেছেন শিক্ষক বনমালী পাল। প্রায় ৪৮ বছরে গড়ে ওঠা ছাত্র-শিক্ষকের এ সম্পর্কের প্রতি যে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে এতে অনেক খুশি এই শিক্ষক। নিজের অনুভূতির কথা জানাতে গিয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার অনেক ছাত্র। তাদের কেউ সচিব, কেউ চেয়ারম্যান, কেউবা মেম্বার। অনেকেই সরকারি-বেসরকারি চাকরি করছে। আমার ছাত্র ডা. এনামুর রহমান এমপি হয়েছে। এখন সে প্রতিমন্ত্রী। সে এখনো শিক্ষকের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ ধরে রেখেছে।

তিনি আরও বলেন, আমি একবার তার সঙ্গে ঢাকায় দেখা করতে গিয়েছিলাম। দুই আড়াই’শ লোকের মাঝে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় ডা. এনামুর রহমান। আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমার প্রতি তার এই শ্রদ্ধা ও সবার সামনে স্কুলশিক্ষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা আমার কাছে অনেক আনন্দের ছিল। সেই দিনের অনুভূতি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

বনমালী পাল বলেন, এখন তো ছাত্ররা শিক্ষককে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। কিন্তু ডা. এনামুর রহমানের মতো ছাত্ররা এখনো শিক্ষককে খুঁজে নিয়ে, ডেকে নিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এ রকম ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম। ডা. এনামুর রহমান উত্তরবঙ্গে আসলেই আমাকে ফোন করে, খোঁজখবর নেয়। সবাইকে বলে আমি তার ছোটবেলার স্কুলশিক্ষক। একজন ছাত্র কতখানি আন্তরিক হলে এই কথাগুলো অকপটে বলতে পারে, এটা চিন্তার বিষয়। আমি তাকে আশীর্বাদ করেছি। মন থেকে, অন্তরের অন্তকরণ থেকে তাকে আশীর্বাদ করেছি যে, সে শুধু প্রতিমন্ত্রী নয়, আগামীতে মন্ত্রী হয়ে দেশের জন্য আরও ভালো কিছু করবে।

অতীতে ও বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কেও পরিবর্তন এসেছে। আমরা আমাদের শিক্ষকদের পা ছুঁয়ে সালাম করতাম। আমি এই বুড়ো বয়সেও আমার শিক্ষকদের পা ছুঁয়ে সালাম করি। এই শিক্ষা আমরা আমাদের সময়কার শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়েছি। এখনো যেসব ছাত্র শিক্ষকের প্রতি এ রকম বিনম্র শ্রদ্ধা জানায়, তারা তাদের শিক্ষক ও অভিভাবকের কাছ থেকে এ শিক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে অবক্ষয় অনেক নিচে নেমে গেছে। এই অবক্ষয়ের কারণে অতীতের ছাত্র-শিক্ষকের যে সম্পর্ক ছিল, সেই সম্পর্কটা এখনকার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে নেই।

শিক্ষক বনমালী পাল বর্তমানে রংপুর নগরীর একটি কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার স্ত্রী সিমানী রায়ও একজন শিক্ষক। তিনি রংপুর সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসরে গেছেন। তাদের একমাত্র কন্যা বিথী পাল ইংরেজিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে শিক্ষক বনমালী পাল বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে থেকে রংপুরকে এগিয়ে নিতে কাজ করছেন। 

আরএআর