যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে চেক জালিয়াতি করে আড়াই কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সরকারের ভ্যাট বাবদ শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ ১০ হাজার ৩৬ টাকার চেক ইস্যু করে। কিন্তু সেই চেকের বিপরীতে প্রতারক চক্র ৯টি চেকের মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকা উত্তোলন করে নেয়। বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) বিকেলে বিষয়টি শিক্ষা বোর্ডের হিসাব শাখা থেকে ধরা পড়ে। 

এ ব্যাপারে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। কলেজ পরিদর্শক কেএম রব্বানিকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। 

এদিকে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেক জালিয়াতির ঘটনায় ক্ষুদ্ধ শিক্ষা বোর্ড কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। বৃহস্পতিবার বিকেলে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের সামনেই উপস্থিত যশোর শিক্ষা বোর্ড এমপ্লইজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান অভিযোগ করেন, বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোল্লা আমীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট নানা অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তারই ধারাবাহিকতায় এই চেক জালিয়াতির ঘটনা। নিরপেক্ষ তদন্ত করলে জড়িতদের নাম বেরিয়ে আসবে। এই জালিয়াতির সঙ্গে শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান সরাসরি জড়িত। আপনারা সিসি ক্যামেরা দেখেন, চেয়ারম্যান রাত পর্যন্ত ভেনার্স প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিকের সঙ্গে সব সময় বসে থাকেন।  

জানা যায়, যশোর শিক্ষা বোর্ডের ২০২০-২০২১ অর্থবছরের আয় ব্যয় বোর্ডের সকল ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট মিল করতে গিয়ে দেখা গেছে বোর্ডের ব্যয় অ্যাকাউন্ট এসটিডি-২৩২৩২৪০০০০০২৪ হিসাব খাতের ৯টি চেক পরিশোধিত হয়েছে। যা বোর্ডে সংরক্ষিত মুড়ি বইয়ের চেকে উল্লেখিত টাকার পরিমাণে সঙ্গে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের পরিশোধ করা টাকার মিল নেই। এ ধরনের অমিল ধরা পড়ায় হিসাব প্রদান শাখার হিসাব রেজিস্ট্রারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। বোর্ডে সংরক্ষিত মুড়ি বইয়ের ৯টি চেকের তারিখ অনুযায়ী হিসাব শাখায় ব্যয় রেজিস্ট্রারের ব্যয় বিবরণীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য চেকগুলো ইস্যু করা হয়। ইস্যুতকৃত চেকগুলোর বিপরীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারি কোষাগারে অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। 

শিক্ষা বোর্ডের ইস্যুকৃত ৯টি চেক জালিয়াতি করে দুটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করেছে। এর মধ্যে ২০২০ সালের ৮ জুলাই আয়কর বাবদ ২ হাজার ৫০০ টাকার চেক ইস্যু করে বোর্ড। ওই চেক জালিয়াতি করে ভেনার্স প্রিন্টিং প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২৫ লাখ ৮০হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করেছেন। একই ভাবে ২০২০ সালের ১২ আগস্ট ভ্যাট বাবদ এক হাজার ২০৭ টাকার ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ১৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনার্স প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট আয়কর বাবদ ৬০০ টাকা চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেকের নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করে শাহী লাল স্টোর নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৩৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। 

২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর আয়কর বাবদ ৬৭৮ টাকার চেক ইস্যু করে বোর্ড। এই চেকের নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ২৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে শাহী লাল স্টোর। একই বছরের ১৯ নভেম্বর ভ্যাট বাবদ ৬০০ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনার্স প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। ২০২১ সালের ৬ মে ভ্যাট বাবদ ৯৯৬ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে ভেনার্স প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। 

একই বছরের ২৯ জুন ভ্যাট বাবদ এক হাজার ৭২৫ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ৪২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনার্স প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। একই বছরের ৩০ জুন ভ্যাট বাবদ এক হাজার ৮০ টাকার চেক ইস্যু করে বোর্ড। ওই চেক জালিয়াতি করে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনার্স প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। 

একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর আয়কর বাবদ বোর্ড ৬৫০ টাকার চেক ইস্যু করেছে। এই চেক জালিয়াতি করে ভেনার্স প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ১৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে। ভ্যাট ও আয়কর বাবদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ১০ হাজার ২৬ টাকা বাবদ ৯টি চেক ইস্যু করে বোর্ড। ওই চেকগুলো জালিয়াতি করে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে। ব্যাংক থেকে পরিশোধ করা চেক/অর্থের বিপরীতে প্রতিষ্ঠান দুটি বোর্ডে কোনো মালামাল বা সেবা সরবরাহ করেনি। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়মানুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান বোর্ডে মালামাল সরবরাহের লক্ষ্যে বোর্ডের সচিব কর্তৃক স্বাক্ষরিত কার্যাদেশ প্রাপ্তির পর কার্যাদেশে উল্লেখিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্টোরে মালামাল সরবরাহ করে বোর্ডের সচিবের কাছে মালামালের চালান ও বিল-ভাউচার দাখিল করবেন। তারপর বোর্ডের সচিব মালামাল বুঝে নেওয়ার জন্য চালান ও বিলের ওপর স্টোর কিপারকে মার্ক করে স্টোরে প্রেরণ করবেন। স্টোর কিপার ওই চালান এবং বিল-ভাউচার সচিব কর্তৃক স্বাক্ষরিত স্মারকে কার্যাদেশ অনুযায়ী মালামাল বুঝে নিয়ে বিল প্রদানের জন্য রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বিল-ভাউচার হিসাব প্রদান শাখায় প্রেরণ করবেন। 

কিন্তু এ ক্ষেত্রে হিসাব প্রদান শাখার কার্যাদেশের মাধ্যমে বিল প্রদানের নথি নিরীক্ষা করে দেখা যায়, ব্যাংক থেকে পরিশোধ করা অর্থের বিপরীতে কোনো বিল-ভাউচার নথিতে উপস্থাপন করা হয়নি। অথচ জালিয়াতি চক্র অন্য বিল হতে ভ্যাট ও আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার লক্ষ্যে ইস্যু করা চেকগুলোর মুড়ির নম্বরের এবং তারিখের মিল রেখে চেক জালিয়াতি করে বোর্ড তহবিলের টাকা আত্মসাৎ করেছে। 

যশোর শিক্ষা বোর্ডের অডিট অফিসার আবদুস সালাম জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরের বিভিন্ন মালামাল ক্রয় বাবদ সরকারের ভ্যাটের ১০ হাজার ৩৬ টাকার ৯টি চেক ইস্যু করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যশোরের ভেনার্স প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ৭টি ও শাহী লাল স্টোর দুটি চেকের মাধ্যমে বোর্ডের ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। বৃহস্পতিবার চেকের মুড়ি বইয়ের সঙ্গে  ব্যাংকের স্টেটমেন্ট মেলানোর সময় এই জালিয়াতি ধরা পড়ে। অথচ মুড়ি বইয়ের চেকের অংকের সঙ্গে ইস্যুকৃত চেকের অংকের মিল নেই। ধারণা করা হচ্ছে বোর্ডের কর্মচারীদের যোগসাজশে ভুয়া চেকের মাধ্যমে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। 

শিক্ষা বোর্ডের সচিব এএমএইচ আলী রেজা বলেন, কার্যাদেশ অনুযায়ী মালামাল ক্রয় করে থাকি। কিন্তু সোনালী ব্যাংক থেকে পরিশোধ করা অর্থের বিপরীতে আমাদের নথিতে কোনো বিল-ভাউচার জমা নেই। ভেনার্স প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইতোপূর্বে আমাদের কিছু মালামাল দিলেও শাহী লাল স্টোরের সঙ্গে কোনো লেনদেন হয়নি। 

এ ব্যাপারে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মোল্লা আমীর হোসেন বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের চেক প্রিন্টিং করা। সেখানে হাতে লেখার সুযোগ নেই। ধারণা করা হচ্ছে জালিয়াতি করে ভুয়া চেকের মাধ্যমে এসব টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা থানায় জিডি করেছি। পাঁচ সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যার প্রধান কলেজ পরিদর্শক কেএম রব্বানি। কমিটির রিপোর্ট আসার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নাজমুচ্ছায়াদাত বলেন,বিষয়টি আমরা শুনেছি, রোববার সব নথি তলব করা হবে। সরকারের টাকা আত্মসাতের সঙ্গে যারাই জড়িত হোক না কেন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। 

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক শিক্ষা বোর্ড শাখার ব্যবস্থাপক এসএম শাহিদুর রেজা জানান, ভেনার্স প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ঢাকার ফকিরাপুল ঠিকানার ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার ক্লিয়ারিং চেকের মাধ্যমে এসব টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। 

তবে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার ব্যবস্থাপক রিয়াদ হাসান বলেন, চেক জালিয়াতির সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সোনালী ব্যাংকের ক্লিয়ারেন্সের ভিত্তিতে চেকের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। 
  
জাহিদ হাসান/আরএআর