ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য নির্মিত ঘর

‌‘মুই কোনো দিন ভাবো নাই পাকা ঘরোত থাকিম। গরিব মানুষ, নিজের থাকার জাগা নাই। পাকা ঘর করিম ক্যামন করি। সেই মুই মানুষটা এলা পাকা ঘরোত থাকিম। আল্লাহ মোর কপাল খুলি দেছে বাহে। প্রধানমন্ত্রী যে উপকার করলে, তা শোধ হবার মতো না। আল্লাহ্ তাক যুগযুগ বাঁচি থুক।’ 

মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠিকানা হওয়ায় আনন্দে আত্মহারা রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা ভূমিহীন ছমেনা বেগম (৬১) এভাবেই ঢাকা পোস্টকে কথাগুলো বলছিলেন।

নির্দিষ্ট জমিজমা না থাকায় দীর্ঘদিন যাযাবর জীবন কেটেছে বিধবা ছমেনার। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ঘর উপহার পাচ্ছেন এই ভূমিহীন বৃদ্ধা নারী। মুখে হাসি ফুটেছে তার। সরকারের অর্থায়নে তৈরি করা পাকাঘর জমিসহ পাচ্ছেন তিনি।

শনিবার (২৩ জানুয়ারি) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য নির্মিত স্বপ্নের লাল-সবুজের রঙে গড়া পাকা নীড় হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন ঘিরে আনন্দে আত্মহারা ছমেনা বেগমের মতো অসংখ্য গৃহহীন ও ভূমিহীন অসহায় মানুষেরা।  

সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবারের জন্য তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে পাকা ঘর। দুই শতক জমির ওপর এক লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। দুই কক্ষ বিশিষ্ট ঘরের সঙ্গে রান্না ঘর, সংযুক্ত টয়লেট ও ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা রাখা হয়েছে। ভূমিহীনদের দুই শতক জমির মালিকানাও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের জন্য ‌প্রথম ধাপে ‘ক’ শ্রেণির পরিবারের পুনর্বাসন ক্যাটাগরিতে ঘরগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে। 

এদিকে রংপুর নগরেরর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দুই অসহায় পরিবারও পাচ্ছে নতুন পাকা ঘর। নগরের শেখপাড়া গ্রামের প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লাচ্চু খালকো ও শ্রী মতি ঠুকি ধানোয়ার জন্য ঘর নির্মাণের কাজও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন শুধু হস্তান্তর কার্যক্রম উদ্বোধনের অপেক্ষা। অবশ্য নতুন ঘর পেয়ে আনন্দে দিশেহারা লাচ্চু খালকো ও মতি ঠুকি। তারা নতুন ঘরে ওঠার প্রস্তুতি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন আয়োজন করছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আদলে নানা আচার অনুষ্ঠান।

ছমেনা বেগম, লাচ্চু খালকো, মতি ঠুকি ধনোয়ারের মতো হাজারো অসহায় গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে এখন আনন্দ বিরাজ করছে। তারা সবাই এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বন্দনায় আত্মহারা। সবার চোখে মুখে স্বপ্ন পূরণের আনন্দ উচ্ছ্বাস। 

তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের ফরিদাবাদ গ্রামের নবনির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার আবুল হোসেন বলেন, সরকারের এই উদ্যোগটা খুবই ভালো। হাজার হাজার মানুষ আছে যারা অভাবের কারণে নিজের মাথা গোঁজার ঘরটুকো তৈরি করতে পারেন না। আবার কারও কারও জমিজমাও নেই। ভূমিহীন ও গৃহহীন এসব মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে এগিয়ে আসছেন, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।  

এদিকে দেশের অন্যান্য জেলার মতো রংপুর বিভাগের সবগুলো জেলায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ঘরসমূহ হস্তান্তরের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রংপুর বিভাগের ৮ জেলার ৫৮ উপজেলায় ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৯৯৮টি। জমি আছে, ঘর নেই এমন পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজার ৮৩৬টি। সর্বমোট ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৩৪টি। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ১৩ হাজার ১১০টি পরিবার ঠাঁই পেতে যাচ্ছে লাল-সবুজের নতুন নীড়ে।

বিভাগের ৮ জেলায় প্রথম ধাপে শনিবার (২৩ জানুয়ারি) ১৩ হাজার ১১০টি ঘরের মধ্যে ৮ হাজার ৯৪৫টি ঘর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হস্তান্তর করবেন। এর মধ্যে সর্বাধিক ঘর হস্তান্তর হবে দিনাজপুর জেলায়। এ জেলায় হস্তান্তরের জন্য ৩ হাজার ২২টি ঘর নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপর রয়েছে কুড়িগ্রামে ১ হাজর ২০৯টি, পঞ্চগড়ে ১ হাজার ৫৭টি, গাইবান্ধায় ৮৪৬টি, রংপুরে ৮১৯টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ৭৮৯টি ঘর হস্তান্তরের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও লালমনিরহাটে ৭৫২টি এবং উদ্বোধনের জন্য সবচেয়ে কম ৪৮১টি ঘর নির্ধারণ হয়েছে নীলফামারীতে। এসবের মধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবার এবং বিলুপ্ত ঘোষিত ছিটমহলে নির্মিত ঘরও রয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় রংপুর জেলার ৮টি উপজেলায় প্রথম ধাপে ২৮৮টি ও দ্বিতীয় ধাপে ৯৮৫টিসহ মোট ১ হাজার ২৭৩টি ঘর তৈরি করা হচ্ছে। এসবের মধ্যে উদ্বোধনী দিনে ৮১৯টি ঘর জমিসহ সুবিধাভোগীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তবে উপকারভোগীদের এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন এসব ঘর নির্মাণ করতে সব মিলিয়ে খরচ হচ্ছে ২১ কোটি ৭৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।

রংপুর জেলায় জমিসহ সুবিধাভোগীদের মধ্যে কাউনিয়া উপজেলার ১২০ পরিবার, রংপুর সদরের ৫০, গঙ্গাচড়ার ১০০, তারাগঞ্জের ২০০, পীরগাছার২২০, মিঠাপুকুরের ১৯৭, বদরগঞ্জের ২৮৬ ও পীরগঞ্জের ১০০টি পরিবারের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে নির্মিত ঘর দেয়া হচ্ছে। পরবর্তী পর্যায়ে এ বছরের মার্চের মধ্যে বাকি ঘরগুলো জমিসহ সুবিধাভোগীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী কর্মকর্তারা এই প্রকল্পের কাজগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করে আসছেন। 

এ ব্যাপারে কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. উলফৎ আরা বেগম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় উপজেলার দুই কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২০টি গৃহহীন পরিবারের জন্য দ্রুত ঘর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরগুলো হস্তান্তর করা সম্ভব হবে।

তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, জমি আছে কিন্তু বাড়ি করার মতো আর্থিক অবস্থা নেই, তাদের জন্যই এই ঘরগুলো প্রধানমন্ত্রীর উপহার। সুবিধাভোগী এ সকল পরিবারের মানুষ দিনে এনে দিন খান। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এ সকল ঘর পেয়ে গৃহহীন পরিবারগুলো অনেক উপকৃত হবেন।

রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের কল্যাণে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। মুজিববর্ষে  ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’- প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষে ইতোমধ্যে দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

সরকারের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় রংপুর জেলার আট উপজেলায় শনিবার (২৩ জানুয়ারি) ৮১৯টি পরিবারের মাঝে জমিসহ ঘর হস্তান্তর করা হবে। বাকি ঘরগুলো কিছু দিনের মধ্যে কাজ শেষ করে হস্তান্তর করা হবে। ২০২১ সালের মার্চের মধ্যেই এসব ঘর জমিসহ সুবিধাভোগীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তবে উপকারভোগীদের এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

আরএআর