‘অভিযানের কয়ডা দিন এনজিওর ঋণের টেহা নেওয়া বন্ধ হলে ভালো হইতো’
মা ইলিশ রক্ষায় রোববার (০৩ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর ১৯০ কিলোমিটার জলসীমায় সকল প্রকার মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। রাত ১২টার পর থেকে ২২ দিনের জন্য মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। এ নিষেধাজ্ঞা চলবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এই খবরে ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী এবং সাগর মোহনা থেকে মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার নিয়ে তীরে ফিরছেন জেলেরা। বন্ধ হয়েছে বরফ কল। বদলে গেছে জেলে ও আড়তদারদের হাঁকডাকে মুখরিত ঘাটের চিরচেনা দৃশ্য।
এদিকে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার কারণে বেকার হয়ে পড়ছেন জেলার প্রায় দুই লাখের অধিক জেলে। এতে অভাব-অনটন ও এনজিওর ঋণের বোঝায় কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে জেলেদের।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে ভোলার ইলিশা, তুলাতুলি, নাসির মাঝি, চডার মাথা ও ভোলার খাল মাছঘাট ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। এ সময় কথা হয় ইলিশা মাছঘাটের জেলে ফরিদ মাঝির সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘এইবার আশায় আছিলাম ইলিশ ধরে এনজিওর দেনা পরিশোধ করমু। এহন অভিযান দিছে, দেনা তো দূরের কথা চাউল কেনার টাহাও যোগাড় হয় নাই। এহন সরকার যদি আমাগো দিকে চাইয়া অভিযানের কয়ডা দিন এনজিওর ঋণের টেহা নেওয়া বন্ধ করতো আমাগো লইগা ভালো হইতো।’
নাছির মাঝি ঘাটের সিরাজল মাঝি বলেন, ‘অভিযানের খবরে নদী থেকে জাল-সাবার লইয়া উইঠা আইছি। ১২টার পর থেইকা নদী তো পুলিশ ও কোস্টগার্ডের দখলে। হেরা যারে পাইবো তাগোরেই আটকাইবো। হেরলইগা আগেই উইঠা আইছি।’
তুলাতুলি মাছঘাটের জেলে সর্দার বশির মাঝি বলেন, মাছ ধরা বন্ধ তা কম বেশি সব জেলেরাই জানেন। তাই অধিকাংশ জেলেরা জাল নৌকা নিয়ে তীরে ফিরেছেন। মহাজন ও আড়ৎদারদের কাছ থেকে অনেকেই দাদনে টাকা নিয়েছেন। কিন্তু এবার মৌসুমে তেমন মাছ পাননি জেলেরা, যেটুকু পেয়েছেন তা দিয়ে দাদনের টাকা তো দূরের কথা ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি তারা। মাছ ধরা বন্ধে এই ২২দিন অনেক কষ্টে দিন কাটবে তাদের। নিষেধাজ্ঞা সময়ে জেলেদের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত চাল সঠিকভাবে বিতরণের দাবি জানান।
ভোলার তুলাতুলি মাছঘাট সংলগ্ন বরফ কলের মালিক ফারুক মোল্লা বলেন, আমার এই বরফ কল মূলত মাছ ঘাটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চালাতে হয়। ঘাটে মাছ থাকলে আমাদের বরফ চলে, মাছ না থাকলে বরফ চলে না। এই ২২ দিনের অভিযানে আমার বরফ মিল বন্ধ রাখতে হবে। আমার এখানে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। তারা এই ২২ দিন বেকার হয়ে পড়বে। কেউ কেউ অন্য পেশা বেছে নেবে। পুনরায় বরফ মিল চালু হলে শ্রমিক সংকটে আমাদের বিপাকে পড়তে হবে।
এদিকে জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, আগামী ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিনের জন্য ভোলার মেঘনা নদীর ৯০ কিলোমিটার ও তেঁতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার এলাকায় মা ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। এ সময় ইলিশ আহরণের পাশাপাশি পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময়ের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আজহারুল ইসলাম জানান, আজ মধ্যরাত থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সব নদীতে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। জেলার প্রতিটি ঘাটে জেলেদের নিয়ে সচেতনতা সভা করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সময় নিবন্ধিত এক লাখ ৩২ হাজার জেলেকে গড়ে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞাকালে নদীতে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হবে। পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ, মৎস্য বিভাগের টহল থাকবে নদীতে। যারা সরকারি আইন অমান্য করে নদীতে গিয়ে মাছ ধরবে তাদের জেল ও জরিমানা করা হবে।
জানা গেছে, ভোলায় প্রায় আড়াই লাখ জেলে থাকলেও সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত নিবন্ধন হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার জেলের। জেলে নিবন্ধন চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ।
গত অর্থবছরে ভোলায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯০ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। যা দেশের মোট ইলিশ উৎপাদনের মধ্যে ৩৩ ভাগ। চলতি অর্থবছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৯০ টন। মৌসুমের প্রথম তিন মাসেই ধরা পড়েছে প্রায় ৫২ হাজার টন ইলিশ।
ইমতিয়াজুর রহমান/আরএআর