মধ্য-নিম্নবিত্তদের নাগালের বাইরে হৃদরোগের চিকিৎসা
সিলেট নগরের হাউজিং এস্টেট এলাকার বাসিন্দা সুরুজ মিয়া (৫১)। স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ের সংসার তার। পরিবার চালানোর একমাত্র অবলম্বন মুদির দোকান। তবে হৃদরোগের কারণে এখন সেই দোকানেও বসতে পারেন না তিনি। একমাত্র ছেলেকে সেই দোকান চালিয়ে সংসার ও বাবার হৃদরোগের চিকিৎসার খরচ চালাতে হচ্ছে।
তবে দোকান থেকে যে আয় হয়, সেই আয় দিয়ে তার বাবার চিকিৎসা করাতে অনেকটা হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। একমাত্র ওষুধের ওপর নির্ভর করেই চলছে তার বাবার চিকিৎসা।
বিজ্ঞাপন
সুরুজ মিয়া বলেন, তিন বছর আগে ফজরের আজানের সময় বুকে একটা চাপা ব্যথা শুরু হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এরপর থেকেই হার্টের ওষুধ খেয়ে যাচ্ছি। এখন চলাফেরায় অনেক কষ্ট হয়। দীর্ঘক্ষণ বসেও থাকতে পারি না।
সুরুজ মিয়ার ছেলে মেকদাদ হোসেন সুমন বলেন, সম্প্রতি আবারও বুকে ব্যথা শুরু হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। তবে চিকিৎসকরা জানান, এখন হার্টে রিং স্থাপন করলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। এটার জন্য প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার প্রয়োজন। এত টাকাও নেই, হার্টের চিকিৎসাও করাতে পারছি না। একটি মাত্র দোকান থেকে মাসে আয় হয় দশ থেকে বারো হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে বোনদের পড়াশোনার খরচ, পরিবারের খরচ চালাব নাকি বাবার চিকিৎসা করাব!
সুরুজ মিয়ার মতো আরও বেশ কয়েকজন হৃদরোগীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। এমনকি ভালো হুদরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারাটাও অপ্রতুল বলে মন্তব্য করছেন তারা। অন্য যারা চিকিৎসক রয়েছেন, তারা অ্যান্টিবায়েটিক দিয়েই রোগ সারাতে চান। এতে রোগীর তেমন একটা উন্নতি হচ্ছে না।
সত্তর বছর বয়সী আব্দুল কাইয়ুম আগে খুব বেশি ধূমপান করতেন। ১৫ বছর আগে প্রায়ই বুকে চাপ অনুভব করতেন। এরপর চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত। এরপর থেকেই তার হৃদরোগের চিকিৎসা চলছে। এখন হৃদরোগ থেকে তিনি শ্বাসকষ্ট রোগেও ভুগছেন।
আব্দুল কাইয়ুমের ছেলে জামিল হোসেন বলেন, হৃদরোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। একেকটা ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। মধ্যবিত্তদের বেশি হিমশিম খেতে হয় হৃদরোগ চিকিৎসা করাতে। পাশাপাশি ভালো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াও অপ্রতুল।
হৃদরোগে আক্রান্ত সিলেট নগরের আম্বরখানা এলাকার বাসিন্দা আইয়ুব বক্স খান বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে আমার হৃদরোগের চিকিৎসা করিয়ে যাচ্ছি। মূলত বুকের ব্যথা থেকেই চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি জানান, হার্টের বাঁ দিকে ব্লক ধরা পড়েছে। এরপর থেকেই চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে আয়ের তিন ভাগের দুই ভাগই খরচ হচ্ছে আমার হৃদরোগের চিকিৎসায়।
তিনি বলেন, হৃদরোগ থেকে আমার ফুসফুসেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে এখন প্রতিদিন ২০ থেকে ২৩টি ওষুধ খেতে হয়। পাশাপাশি ডায়াবেটিসের ইনসুলিনও ব্যবহার করতে হয়।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন হৃদরোগের একটি বড় কারণ। এ ছাড়া অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড, কোলেস্টেরল ফুডের প্রতি ঝোঁক, কায়িক পরিশ্রম না করা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও ধূমপানের কারণে হুদরোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম বলেন, মানুষ এখন অনিয়ন্ত্রিত জীবন পরিচালনা করছে। আগে যেখানে হাঁটাচলাসহ কায়িক পরিশ্রম করা হতো, এখন আর সেসব হচ্ছে না। মানুষ এখন শুয়েবসে জীবযাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে। এসব কিছু হৃদরোগ হওয়ার অন্যতম কারণ।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমরা যে খাবারই খাচ্ছি না কেন, তাতে ভেজালের পরিমাণ বাড়ছে। সব মিলিয়েই আমাদের হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এসব পরিহার করে নিয়মিত ব্যায়াম ও খাবার বাছাই করে খেলে হৃদরোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
এনএ