১৯৮৮ সালে স্থানীয়দের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যালয়টি। ২০১৩ সালে এটি সরকারি হয়। মাঝখানে কেটে গেছে তিন দশকেরও বেশি সময়। এই দীর্ঘ সময়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার রাস্তা না থাকায় বর্ষায় ঝুঁকি নিয়ে কলাগাছের ভুরায় (ভেলা) ও কাদাপানিতে যাতায়াত করতে হয়েছে হাজারো তারেক, নাবিলা, লামিয়াকে। আর শুকনা মৌসুমে অন্যের বাড়ির ওপর ও ক্ষেতের আইল দিয়ে যেতে হয় বিদ্যালয়ে। এভাবে যেতে গিয়ে কখনো কখনো তো শুনতে হয় জমির মালিক ও বাড়িওয়ালাদের গালাগালিও।

৩৩ বছর ধরে বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য একটি রাস্তা হয়নি। কোমলমতিরা শিশুরা এখন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। কিন্তু এ ব্যথা যেন ছুঁয়ে যায়নি কারও মনে। এলাকাবাসী ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, অনেক জায়গায় ধরনা দিয়েও হয়নি কোনো লাভ। মেলেনি কোনো সমাধান। সড়ক থেকে প্রায় আড়াই শ মিটার দূরে মাঠের ভেতরে এভাবেই একাকী দাঁড়িয়ে আছে বিদ্যালয়টি।

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার পাঙ্গাসী ইউনিয়নের বেংনাই উত্তরপাড়ায় অবস্থিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। মহাসড়কের পাশের ক্যানেলে প্রায় বছর দশেক আগে একটি কালভার্ট নির্মাণ করা হলেও সেটি তুলনায় অনেক ছোট। দায়সারা কালভার্টটি নির্মাণ করা হলেও এত বছরেও দুপাশে ভরাট হয়নি মাটি। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও এলাকাবাসীর এখন যেন স্কুলের রাস্তাটি প্রাণের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরেজমিনে গেলে জানা যায়, বিদ্যালয়টিতে ১৬৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কিন্তু রাস্তা না থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আসে না। এদিকে স্কুল ছুটি হলে বাড়ির পথ ধরে শিক্ষার্থীরা। তারেক, নাবিলা, লামিয়াসহ পঞ্চম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলে, এখন তো পানি কমে গেছে। তাই অন্যের জমির আইল ও বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়া যায়। আর কদিন আগে সেই বাড়িগুলো পেরিয়েও যেতে হতো কাদাপানি মাড়িয়ে। আর বর্ষার সময়তো কলাগাছের ভুরাই একমাত্র ভরসা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে মহাসড়কের মাত্র আড়াই শ মিটারের মধ্যে হলেও এখনো যেন নজরে আসেনি কারও।

তারেক, নাবিলা, লামিয়ারা ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে দুঃখভরা মনে বলে, স্যার, আমাদের আর এভাবে মানুষের বাড়ির ও জমির ওপর দিয়ে স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। মাঝেমধ্যে তো তারা বকাবকিও করে। আমরা সবাই সুন্দরমতো রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতে চাই। স্যার, আমাদের একটা রাস্তা করে দেবেন?

বেংনাই উত্তরপাড়ার আব্দুর রাজ্জাক, সোলাইমান শেখ, খাইরুজ্জামান, জাহিদুল ইসলামসহ অনেকে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এ বিষয় নিয়ে অনেকবার বলেছি। আজও কোনো সমাধান হয়নি। বর্ষায় যখন কলাগাছের ভুরায় শিশুরা স্কুলে যায়, আমরা আতঙ্কে থাকি। কখন না জানি কী খারাপ খবর আসে। এ ছাড়া শুকনা মৌসুমে স্কুলে যেতে হয় মানুষের বাড়ি ও জমির ওপর দিয়ে। তখন অনেকে খারাপ ব্যবহার করে। এ রাস্তাটি এখন আমাদের প্রাণের দাবি বলেও জানান তারা।

বেংনাই উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উম্মে জান্নাতী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে ১৬৫ জন শিক্ষার্থী আছে। আমরা বিভিন্ন সময় ধরনা দিয়েছি, দরখাস্ত দিয়েছি কিন্তু কোনো সমাধান পাইনি। তিনি আরও জানান, শিশুরা বর্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলার ভুরায় করে আবার পানি কমলে কাদাপানি মাড়িয়ে স্কুলে আসে। আর বাকি সময় আসে মানুষজনের বাড়ি ও ক্ষেতের আইল দিয়ে। এতে তাদের বকা শুনতে হয়। 

পাশেই পানির পুকুর আছে জানিয়ে বলেন, শুকনার মৌসুমেও যদি বাচ্চারা পা পিছলে সেখানে পড়ে যায়, তাহলে প্রাণহানি বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেহেতু এটা বৃহৎ কাজ, তাই এমন কাজ করার মতো ফান্ডও আমাদের নেই। তাই একটি রাস্তার জন্য সরকারের কাছে প্রার্থনা করছি।

বেংনাই উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শেখ আব্দুর রহিম মাস্টার বলেন, ছেলেমেয়েরা খুব কষ্ট করে স্কুলে যায়। এখানে একটি রাস্তা বা ফুটওভারব্রিজ খুবই দরকার। আবার পাশেই একটি ঈদগাহ মাঠ আছে। একটি রাস্তা হলে সবার জন্য খুবই উপকার হবে।

পাঙ্গাসী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সালাম বলেন, আমি ২০১২-১৩ অর্থবছরে এডিপির একটি দুই লাখ টাকার কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে দিয়েছিলাম সেখানে একটি কালভার্ট নির্মাণের জন্য। কিন্তু ঠিকাদার তখন কাজ শেষ না করেই অফিস থেকে বিল উত্তোলন করে নিয়ে যায়। আমি জানি না কীভাবে তারা বিল পেল। তিনি আরও বলেন, আমি চেষ্টা করব সামনে কোনো প্রকল্প এলে সেটি দিয়ে এখানে শিশুদের জন্য একটি রাস্তা নির্মাণ করে দেওয়ার।

রায়গঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নিজেও বিষয়টি দেখেছি। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি ২০১৩ সালের জানুয়ারি সরকারিভুক্ত হয়। কিন্তু আজ অবধি রাস্তা না হওয়াটা সত্যিই খুব দুঃখজনক। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে যেতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, কোমলমতিরা যেন সঠিকভাবে নির্বিঘ্নে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে এর জন্য আমি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে একটি রাস্তা নির্মাণের জন্য কথা বলব।

রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিবুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বিষয়টি জানি না। তবে এ রকম হয়ে থাকলে বা সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য রাস্তা না থাকলে অথবা দরকার হলে আমাদের কাছে কোনো আবেদন এলে আমরা অবশ্যই সেটা পর্যালোচনা করে রাস্তাটি করে দেওয়ার পদক্ষেপ নেব।

এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এখানে আসার পর থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তাই বিষয়টি জানি না। তবে আমি রায়গঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে একটি রাস্তার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।

এনএ