দীর্ঘ ৩৫-৪০ বছর পর এবার সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার চলনবিলে শোভা পাচ্ছে জলজ রানী পদ্মফুল। ভাদ্রের মাঝামাঝি সময়ে কলি থেকে ফুল ফোটা শুরু হয়েছে। শীতের আগমনী পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন জলজ উদ্ভিদ গবেষকরা। 

জানা গেছে, তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নের সোলাপাড়া মাঠে ও মাগুরা বিনোদ ইউনিয়নের দোবিলা ও ঘরগ্রামের মাঠে ফুটেছে পদ্মফুল। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী গুরুদাসপুরের একটি মাঠ যেন পদ্মফুলের অভয়ারণ্য। 

তাড়াশ উপজেলার সোলাপাড়া গ্রামের দুলাল চন্দ্র জানান, চারদিকে পুকুর খনন করায় ফসলি মাঠগুলো সারা বছর জলাবদ্ধ থাকে। এ বছর মাত্র একটি পদ্মফুলের গাছ লাগানো হয়েছিল। এখন আমার দুই বিঘাসহ পাশের জমিগুলোতে হাজার হাজার গাছ ও পদ্মফুল ফুটছে। দেখলে মনে হয় ছোট্ট বিলটি যেন এক অপরূপ সাজে সেজেছে। পদ্মফুলের সৌন্দর্য দেখতে অনেক লোক আসে। আবার কেউ কেউ কোমর পানি ডিঙিয়ে তুলে নিয়ে যায় ফুল। 

কথা হয় দোবিলার বিল থেকে একটি পদ্মফুলের গাছ এনে লাগানো তাড়াশ সদর ইউনিয়নের সোলাপাড়া গ্রামের মৃত তারাপদ মাহাতোর ছেলে জগদীশ চন্দ্র মাহাতোর সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি পদ্মফুলের গাছ চলনবিল এলাকা থেকে নিয়ে এসে শখের বসে ভাগিনা দুলাল চন্দ্র সূত্রধরের ডোবায় লাগিয়েছিলাম। এখন সেখানে প্রায় ১৫০০ গাছ ছাড়িয়ে গেছে। আমি ভাবতে পারিনি,  একটি গাছ থেকে এত গাছ হবে।

জানা যায়, এককালে চলনবিলে হরেক রকম জলজ উদ্ভিদ ছিল। বিলের বিভিন্ন প্রান্তে ফুটে থাকত শাপলা ও পদ্ম। পদ্ম ফোটার সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য মানুষকে আবেগতাড়িত করত। বিলের মানুষ পদ্মপাতায় ভাত খেত। হাট থেকে লবণ, জিলেপি ও গুড় পদ্মপাতায় মুড়িয়ে নিয়ে আসত। বিলের জলাধার দিনের পর দিন কমতে থাকায় ধীরে ধীরে তা হারিয়ে যাওয়ার পথে। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও সালেহা ইসহাক সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক সাথী রাণী ঘোষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্ম শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদ। তাই দু-একটি গাছ থেকে এটি বংশ বৃদ্ধি করে।পদ্ম চলনবিলের ঐতিহ্য হলেও এখন আর খুব বেশি দেখা যায় না। তবে একে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ প্রায় চার দশক পরে চলনবিলে পদ্ম ফিরে আসা প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্ম একটি বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। পদ্মফুলের একটি পরিপক্ষ বীজ এক হাজার বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। অনুকূল পরিবেশ পেলে সে আবারও বংশ বিস্তার করে থাকে। চলনবিলে ফোটা পদ্মের ক্ষেত্রেও সেটিই হয়েছে। 

চলনবিলের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন নামে ১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল। এসব বিলে পদ্ম, শাপলা, মাখনা, সিঙ্গট, গেচু, চেচুয়া, ভাতসোলাসহ বহু প্রজাতির সপুষ্পক, ফার্ন, মস ও শৈবাল পাওয়া যেত। এর মধ্যে অনেকগুলো এখন বিপন্ন এবং বেশ কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

চলনবিল এলাকার বাসিন্দারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলনবিলে পদ্ম ফুটেছে দীর্ঘ প্রায় চার দশক পরে। হারিয়ে যাওয়া পদ্ম ফিরে আসায় উচ্ছ্বসিত চলনবিলবাসী। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মো. জামালের গবেষণাতেও প্রায় একই চিত্র উঠে এসেছে। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত চলনবিল নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। সেখানে তিনি তাড়াশ উপজেলায় বিলে পদ্ম দেখেছেন। কিন্তু এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষকরা এ অঞ্চলে আর কোনো পদ্মফুল দেখতে পাননি বলে ঢাকা পোস্টকে জানান অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ।

এসপি