কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়ার মারিশবনিয়ার পাহাড় থেকে নামার সময় অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে ডাকাত বলে ঘোষণা দেন পুলিশের তিন সোর্স নুরুল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। মারিশবনিয়া মসজিদের ইমামসহ সংশ্লিষ্টরা বাঁধা দিলেও জোর করে মসজিদে ঢুকে পড়েন তিনজন। তারপর পাহাড় থেকে সিনহাদের ডাকাত বলে মাইকে ঘোষণা দিতে থাকেন।

মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার সময় এমন তথ্য উপস্থাপন করেছেন মারিশবনিয়া জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ জহিরুল ইসলাম।

দীর্ঘ এক ঘন্টা ১৫ মিনিট পুলিশের সোর্সরা কীভাবে মাইকে সিনহাকে ডাকাত বলে ঘোষণা দিয়েছেন তার বর্ণনাও দেন তিনি। তারপরই তাকে জেরা করেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ আসামির আইনজীবীরা।

এর আগে সিনহা হত্যা মামলায় তৃতীয় ধাপে সাক্ষ্য গ্রহণের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকাল সোয়া ১০টা থেকে শুরু হয়ে বিচারিক কাজ চলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত। আজকে এ মামলার দুই সাক্ষী হাফেজ জহিরুল ইসলাম ও ডা. রণবীর দেবনাথ সাক্ষ্য দিয়েছেন। মূলত চিকিৎসক রণবীর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ওপর সাক্ষ্য দিয়েছেন।

আদালত চত্বরে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০ ও ১১ নম্বর সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা শেষ হয়েছে। আগামীকাল তৃতীয় ধাপের শেষ দিনে সাক্ষ্য দেবেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শাহীন আব্দুর রহমান।

তবে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের আইনজীবী রানা দাশ গুপ্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ যে সকল সাক্ষী উপস্থাপন করছে তারা কারা তা বুঝতে আমাদের এখন আর বাকি নেই। কোনো এক মহলের নির্দেশে তারা সাক্ষ্য দিচ্ছেন। কারণ তাদের কথার সঙ্গে চার্জশিটের মিল থাকছে না।

এখন পর্যন্ত এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন নিহত সিনহার বোন ও মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসসহ ১১ জন। তারা এ হত্যাকাণ্ডের নানা দিক তুলে ধরে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে পুলিশ আটক করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করা হয়। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান।

সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। ঘটনার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র‍্যাব।

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র‍্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম।

আসামিদের মধ্যে পুলিশের ৯ জন সদস্য রয়েছেন। তারা হলেন, বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেবল রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া ও কনস্টেবল সাগর দেব নাথ।

অপর আসামিরা হলেন- আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আব্দুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিষবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের করা মামলার সাক্ষী নুরুল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

গ্রেফতার হওয়া আসামিদের মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এর আগে আসামিদের তিন দফায় ১২ থেকে ১৫ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল।

মুহিববুল্লাহ মুহিব/আরএআর