নীল সংগ্রামের স্মৃতিচিহ্ন মেহেরপুরের দুই নীলকুঠি
‘নীলচাষ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোনো ইংরেজ বড় লাটের হাতে চাবুক, অসহায় কৃষকের চোখে জল, আহাজারি ও ক্ষুধার হিংস্র থাবা। নীল চাষ নিয়ে বিভিন্ন সাহিত্যে যেমন বর্ণনা রয়েছে, তেমনি কলঙ্কিত আগ্রাসন ও ক্লেশময় সামাজিক সংগ্রামের চিহ্ন হয়ে আছে মেহেরপুরে নীলচাষের ইতিহাস।
মেহেরপুরে বিভিন্ন এলাকায় নীলচাষের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি নীলকুঠি স্থাপন করা হয়েছিল। এর মধ্যে সব বিলুপ্ত হয়ে ভিটেমাটি নিশ্চিহ্ন হয়ে আছে। কাজলা নদীর তীরে আমঝুপি ও গাংনীর ভাটপাড়ায় সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলকুঠি।
বিজ্ঞাপন
ইংরেজদের শাসন ও শোষণের এসব স্মৃতিচিহ্ন আজ বহন করছে অন্য পরিচয়। ইতোমধ্যে নীলকুঠি দুটিতে গড়ে তোলা হয়েছে ডিসি ইকোপার্ক। তবে সেখানে ইংরেজদের ফেলে রাখা স্মৃতিচিহ্ন নীলগাছ রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। পর্যটক ও দর্শনার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে স্থান দুটি।
জানা যায়, ১৭৭৮ সালে ক্যারল ব্লুম নামে এক ইংরেজ ব্যক্তি ভাটপাড়া কাজলা নদীর তীরে ২৩ একর জমির ওপর নীলকুঠি স্থাপন করেন। তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীল ব্যবসায়ীদের দোর্দণ্ড প্রতাপে দিশেহারা ছিল নীল চাষিরা। নির্যাতিত নীল চাষিদের দুর্বার আন্দোলনের মুখে বাংলার বুক থেকে নীল চাষ নিশ্চিন্ন হয়ে গেলেও নীলকরদের অত্যাচার, নির্যাতন ও শোষণের স্মৃতি নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ভাটপাড়া নীলকুঠি।
কালের বিবর্তনে অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হয় নীলকুঠি। দামি মার্বেল পাথর আর গুপ্তধনের আশায় ভেঙে ফেলা হয়েছে মূল ভবনসহ সবকিছু। তবে আগাছার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জন্ম নিয়েছে নীলগাছ। তবে ইংরেজদের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে ইকোপার্ক। এদিকে মূল ভবনে অবকাঠামো ঠিক রাখা হয়েছে। বাড়তি সংযোজন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ, ঔষধিগাছের বাগানসহ নানা নান্দনিক কারুকার্য। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলো বিনষ্ট হচ্ছে।
একই সময়ে ইংরেজদের নীল চাষ ও প্রশাসনিক সদর দফতর হিসেবে পরিচিত ছিল আমঝুপি নীলকুঠি। নীল চাষ অত্যধিক লাভজনক হওয়ায় এখানে নীল চাষ শুরু হয়। একসময় মেহেরপুর অঞ্চলে রানী ভবানীর জমিদারি ছিল। রানী ভবানী নিহত হওয়ার পর হাতবদল হয়ে গোটা অঞ্চলটি মথুরানাথ মুখার্জির জমিদারিভুক্ত হয়। পরে তার ছেলে চন্দ্র্র মোহন বৃহৎ অঙ্কের টাকা নজরানা নিয়ে মেহেরপুরকে জেমস হিলের হাতে তুলে দেন। সেই থেকেই এখানে কুঠি স্থাপিত হয়।
এখানে রয়েছে নীলকরদের অত্যাচারের স্মৃতিচিহ্ন স্নেকপ্রুফ কক্ষ, নাচঘর, কবুতর ঘর, মৃত্যুকূপ ও শাণবাঁধানো ঘাট। কাজলা নদীর এখান দিয়েই রফতানি করা হতো নীল রং। কথিত আছে, নবাব সিরাজউদদৌলার শাসনামলে বাংলার স্বাধীনতা হরণের নীলনকশাও নাকি এ নীল কুঠিতে বসেই হয়েছিল।
ভাটপাড়া নীলকুঠি ও নীল চাষ দেখতে আসা বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া শিক্ষার্থী হুমায়ুন কবির সুমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বইপুস্তকে পড়া বাঙালির নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন নীলকুঠি বাড়ি দেখতে এসেছি। এখানে নীলগাছ দেখতে পেয়ে ভালো লাগল। আমাদের মতো নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের বাস্তবতা দেখালাম। এগুলো সংরক্ষণ করা উচিত।
মেহেদী হাসান নামের একজন বলেন, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নীলগাছ সংরক্ষণ করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে নীল কর্নার নির্মাণ করাসহ নীলকুঠির মূল ভবন সংস্কার করা প্রয়োজন। এসব উদ্যোগ নিলে মানুষ সহজে সবকিছু জানতে পারবে।
ভাটপাড়া নীলকুঠির কেয়ারটেকার আইয়ুব আলী বলেন, অনেক এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি নীলগাছ থেকে এক জায়গায় একটি নীলবাগান করা হচ্ছে। অনেকেই আমার সঙ্গে নীলগাছের বর্ণনা শুনতে চান। আমি যতটুকু বইপুস্তক আর ইতিহাসে জেনেছি, নতুন প্রজন্মের কাছে ততটুকু জানাতে চেষ্টা করি।
মেহেরপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন বলেন, জাতির এক কলঙ্কিত ইতিহাস নীলকরদের নির্যাতনের ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষ অনেক শোষণ আর নির্যাতন সহ্য করে প্রতিবাদ করতে শিখেছিল। এই বাঙালি তাদের উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছে। এটি শুধু নির্যাতনের ইতিহাসই নয়, এ ইতিহাস আমাদের বিজয়ের ইতিহাস। নীলকুঠি সংরক্ষণের বিষয়ে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এনএ