২৫ বছর পর আপন ঠিকানায় ফিরলেন আঁখিনুর
২৫ বছর আগের কথা। ছোট্ট মেয়ে আঁখিনুর পাশের বাসার এক বৃদ্ধার টাকা চুরি করায় তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বাবা মানিক মিয়া। চিন্তা করেছিলেন মেয়েকে ভয় দেখিয়ে শিক্ষা দেবেন। সেই চিন্তা মোতাবেক মেয়েকে রাজধানীর গুলিস্তান এলাকার একটি রাস্তার মোড়ে পানের দোকানের সামনে রেখে আড়াল হয়েছিলেন বাবা।
তবে, আড়ালে গিয়ে পড়েন ছিনতাইকারীর কবলে। পরে তাদের হাত থেকে ছাড়া পেতে বেশ দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে এসে দেখেন সেখানে আর তার মেয়ে নেই। পরে অনেক খুঁজেও পাননি মেয়েকে।
বিজ্ঞাপন
এরপর কেটে গেছে পঁচিশটি বছর। ধরেই নিয়েছিলেন আর ফিরে পাবেন না মেয়েকে। তবে সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে অবশেষে জনপ্রিয় রেডিও জকি (আরজে) কিবরিয়ার ‘আপন ঠিকানা’ অনুষ্ঠানে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আঁখিনুর খুঁজে পেয়েছেন তার মা-বাবাসহ পরিবারকে। ফিরে গেছেন তার আপন ঠিকানায়।
গত শুক্রবার (১৮ সেপ্টম্বর) ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার লংগাইর ইউনিয়নের মাইজবাড়ী গ্রামে নিজ বাড়িতে ফেরেন তিনি। সেখানে মেয়েকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা পুরো পরিবার।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে ঢাকার একটি কোম্পানিতে পিওন পদে চাকরি করতেন মানিক মিয়া। সেই সুবাদে স্ত্রী, দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতেন রাজধানীতেই। একদিন ওই ঘটনায় তার ছয় বছরের শিশুকন্যা আঁখিকে হারানোর পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান মেলেনি। মেয়ের সন্ধানে এলাকায় মাইকিং, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও থানায় সাধারণ ডায়েরি করাসহ কবিরাজের কথায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন বাবা মানিক মিয়া। তবুও পাওয়া হয়নি মেয়েকে।
সম্প্রতি ‘আপন ঠিকানা’ শিরোনামে এক অনুষ্ঠানে আঁখির একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার প্রচার করেন আরজে কিবরিয়া। সেই সূত্রেই আঁখির সন্ধান পায় তার পরিবার।
সেই সাক্ষাৎকারে আঁখিনুর বলেন, সেদিন বাবাকে না পেয়ে অনেক কান্নাকাটি করে একটি লেগুনায় উঠি। আমাকে কাঁদতে দেখে এক লোক আমাকে নিয়ে যান। পরে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে আসেন। এরপর থেকে শুরু হয় নতুন এক জীবন। আশ্রয়কেন্দ্রেই বড় হই। সেখান থেকে বের হয়ে একটি বিউটি পার্লারে কাজ শুরু করি। এক সময় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আশুলিয়ার মাসুম মোল্লার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং পরে বিয়ে করি। স্বামীর সঙ্গে সেখানেই বসবাস করছি। এখন আমি এক ছেলে ও এক মেয়ের মা।
তিনি আরও বলেন, মোবাইলে মাঝেমধেই ‘আপন ঠিকানা’ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মানুষের হারিয়ে যাওয়া ও পরিবার ফিরে পাওয়ার গল্প শুনি। আমারও মন চাইতো, আমার হারিয়ে যাওয়ার গল্পটা যদি বলতে পারতাম। আর আমার মা-বাবা যদি সেটা শুনে আমার খোজঁ নেয়। তাই ওই অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার চেয়ে আবেদন করি। বহুদিন অপেক্ষা করে ডাক পাই। পরে সেখানে আমার সাক্ষাৎকার প্রচার করা হলে তা ফেসবুকে অনেক শেয়ার হয়। সেই সূত্র ধরেই আমার পরিবার আমার খোজঁ পায়।
দীর্ঘদিন পর মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের কাছে পেয়ে আঁখি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, এ আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না। একই রকম আপ্লুত পরিবারের অন্য সদস্যরাও।
আঁখির বাবা মানিক মিয়া বলেন, এত বছর পরে এভাবে মেয়েকে খুঁঁজে পাব তা কখনও কল্পনাও করিনি। মেয়ে হারানো যে কত কষ্টের, তা সেই বাবা-মা-ই বোঝেন। দীর্ঘদিনের চাপা কষ্ট অবশেষে দূর হলো।
মা জহুরা বেগম বলেন, মেয়ে হারানোর পর অনেক কান্নাকাটি করেছি। আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে মেয়েকে চেয়েছি। এত বছর পর হলেও আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন, মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখন আমার আর কোনো কষ্ট নাই।
হারিয়ে যাওয়া পরিবারের কাছে ফিরেছে স্ত্রী আঁখি, যারপরনাই উচ্ছ্বসিত স্বামী মাসুম মোল্লা। বলেন, আমি সব কিছু জেনেই আঁখিকে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পরও তার পরিবারকে খুঁজে পেয়ে অনেক চেষ্টা আমি করেছি। আরজে কিবরিয়া ভাইয়ের কারণে সেই চেষ্টা অবশেষে স্বার্থক হলো। উনি হারিয়ে যাওয়া এমন অনেককেই তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন। আল্লাহ উনার মঙ্গল করুক।
উবায়দুল হক/এমএএস